বিধানসভায় কর্মশালায় সৌগত রায়ের সঙ্গে করমর্দন তন্ময় ভট্টাচার্যের। — নিজস্ব চিত্র।
ক্লাস নিতে এসে এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হবে, পোড় খাওয়া শিক্ষক তা বোধহয় আঁচ করতে পারেননি। তাই এক ঢোঁক জলের মতোই ছাত্রের খোঁচা হজম করতে হল তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়কে।
মূলে সেই নারদ-কাণ্ড। যাতে সৌগতবাবুর নামও জড়িয়েছে। আর তাঁকে হুল ফুটিয়েছে বিরোধী সিপিএম— নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে উত্তর দমদমের সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য। তাঁর আপাত নিরীহ প্রশ্নের মোড়কে যে মোচড় যথেষ্টই ছিল, সৌগতবাবু তা মেনে নিয়েছেন। তন্ময়বাবুর হাবে-ভাবেও পরিষ্কার, হাতের সামনে এমন সুযোগ পেয়ে তাঁরা হাতছাড়া করতে চাননি।
সুযোগটা এসেছিল সোমবার। বিধানসভায় নবনির্বাচিত সদস্যদের পরিষদীয় রাজনীতির পাঠ দিতে কর্মশালার আয়োজন হয়েছিল। রাজনীতিতে দক্ষতার সুবাদে সৌগতবাবুকে উপদেষ্টা হিসাবে ডেকে এনেছিলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বাম আমলের পরিষদীয় মন্ত্রী প্রবোধ সিংহের পাশাপাশি। কী ভাবে বিধানসভায় মুলতবি বা অন্যান্য প্রস্তাব আনতে হয়, সে সব কৌশল নিয়ে চর্চার ফাঁকেই দমদমের সাংসদকে প্রশ্ন করার জন্য উঠে দাঁড়ান তন্ময়বাবু। জানতে চান, কী ভাবে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব আনা যায়।
আর ওই ‘নিরীহ’ কৌতূহলের আড়ালে যে সৌগতবাবুর জন্য স্টিংয়ের খোঁচা মজুত, তা বুঝতে উপস্থিত কারও দেরি হয়নি। এখন যেমন নারদ-কাণ্ড নিয়ে হইচই, তত বড় আকারে না হলেও ২০০৭-এ গোপন ক্যামেরায় তৎকালীন শাসক ফ্রন্টের এক বিধায়কের ঘুষ নেওয়ার ছবি বিধানসভায় তোলপাড় ফেলেছিল। সিপিআই বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের টাকা হাতে ছবি গোটা বিধানসভার সম্মানহানি ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করে তাঁর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব এনেছিলেন তৃণমূল বিধায়ক সৌগতবাবুই। যার ভিত্তিতে তদানীন্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম ওই অভিযোগের তদন্তের জন্য কংগ্রেস বিধায়ক জ্ঞানসিংহ সোহনপালের (চাচা) নেতৃত্বে একটি অ্যাড হক কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন। কমিটি রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগেই অবশ্য ইলিয়াস পদত্যাগ করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গই টেনে এনে এ দিন সৌগতবাবুর উদ্দেশে তন্ময়বাবুর প্রশ্ন ছিল— ‘‘আপনার সেই স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাবের পরবর্তী কালে ইলিয়াসকে বিধায়ক পদ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এখন আমি যদি কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে কোনও প্রস্তাব আনতে চাই, তা হলে কী করতে হবে?’’
তন্ময়বাবু কিন্তু এক বারও নারদ-কাণ্ডের নাম সরাসরি নেননি। তবে তিনি বিলক্ষণ জানতেন, নারদের ভিডিওয় খোদ সৌগতবাবুরও টাকা নেওয়ার ফুটেজ আছে! আর উপদেষ্টার চেয়ারে বসে সৌগতবাবুও বুঝেছেন, তির যেখানে বেঁধার, বিঁধে গিয়েছে! বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোঁক জল গলায় ঢেলে তিনি নেহাতই আইনগত উত্তর দিয়েছেন— বিধানসভার কার্যবিধির ২২৪ ধারায় এই মর্মে প্রস্তাব আনা যেতে পারে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব আনতে গেলে কাগজের কাটিং বা ফুটেজের সিডি জমা দিতে হবে। তার পরে স্পিকার মনে করলে অভিযোগের তদন্ত করাতে কমিটি গড়তে পারেন।
তবে কর্মশালার বাইরে সৌগতবাবুকেও মেনে নিতে হয়েছে, ‘‘ওঁর প্রশ্নে একটা খোঁচা তো ছিলই!’’ আর আকর্ণ হেসে তন্ময়বাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘বাইরে মানুষ নারদ-কাণ্ড নিয়ে চর্চা করছেন। তাঁদের প্রতিনিধি হিসাবে বিধানসভায় আমায় যদি কোনও প্রশ্ন বা পদক্ষেপ করতে হয়, তার পদ্ধতিটা জেনে নিতে চেয়েছিলাম।’’ সৌগতবাবু থাকবেন জেনেই যে ওই পদ্ধতি জেনে নেওয়ার তাগিদ জন্মেছিল, বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর হাবভাবেও তা গোপন থাকেনি!
কর্মশালা করাতে এসে নিজের দলের খোঁচাও অবশ্য এ দিন হজম করতে হয়েছে সৌগতবাবুকে। নতুন বিধায়কদের উপদেশ দিতে গিয়ে তৃণমূলের সুদীপবাবু বলেই ফেলেছেন, তাঁর সতীর্থ অবশ্যই ভাল সাংসদ। সুবক্তা। কিন্তু এমন কথা মাঝেমাঝে বলেন, যাতে দলকেই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়! নিজেদের মুখরক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়! এই খোঁচা অবশ্য গম্ভীর মুখেই সয়ে নিয়েছেন দমদমের সাংসদ। মাত্র কয়েক দিন আগেই বরাহনগরে নতুন সরকারি উপ মুখ্য সচেতক তাপস রায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রখর আত্মসমালোচনায় যিনি দলকে খানিকটা বিড়ম্বনাতেই
ফেলে এসেছিলেন!
প্রসঙ্গত, বাজেটের নানাপ্রকরণ বোঝাতে গিয়ে সুদীপবাবু এ দিন বাংলার জন্য কেন্দ্রের বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের দাবি করেছেন। যার প্রেক্ষিতে বিজেপি’র দিলীপ ঘোষ পরে বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ প্যাকেজ পেতেই পারে। কিন্তু যে টাকা কেন্দ্র ইতিমধ্যে রাজ্যকে দিয়েছে, সেই টাকা কোন খাতে কী ভাবে খরচ হল, তার ব্যাখ্যা আগে রাজ্য সরকার দিক! কেন্দ্রের টাকায় মেলা-খেলা-মোচ্ছব কোনওটাই করা যায় না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy