গত কয়েক বছরে বিজিবিএসে বেশ কয়েক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। রাজ্য সরকারের তরফে তেমনই দাবি করা হয়েছে। গত বছর এই বাণিজ্য সম্মেলন হয়নি। এ বছর বিজিবিএসের অষ্টম পর্যায়ের (এডিশন) সম্মেলনটি শুরু হচ্ছে আজ, বুধবার বিশ্ব বাংলা কনভেনশন কেন্দ্রে। তার আগে সরকারের মধ্যেই কৌতূহল, এ বারের বিনিয়োগ প্রস্তাব আগের বছরগুলিকে ছাপিয়ে যাবে কি না। যদিও বিরোধীদের দাবি, এই প্রস্তাবের অধিকাংশই খাতায়কলমে। বাস্তবে তার কোনও চিহ্ন এখনও দেখা যায়নি। তারা ফের বিষয়টি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি তুলেছে। পাল্টা তৃণমূলের দাবি, কোনও সরকারই আজ পর্যন্ত এমন কোনও শ্বেতপত্র প্রকাশ করেনি।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে বিজিবিএস-এর গত সাতটি এডিশন মিলিয়ে প্রায় ১৯.৫১ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে রাজ্য। তার মধ্যে ২০১৫ সালে ২.৪৩ লক্ষ কোটি, ২০১৬ সালে ২.৫০ লক্ষ কোটি, ২০১৭ সালে ২.৩৫ লক্ষ কোটি, ২০১৮ সালে ২.১৯ লক্ষ কোটি এবং ২০১৯ সালে ২.৮৪ লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছিল। ২০২২ সালে বিনিয়োগ প্রস্তাব বেড়ে হয় ৩.৪২ লক্ষ কোটি এবং ২০২৩ সালে তা হয় প্রায় ৩.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে সম্মেলন হয়নি। ফলে চলতি বছর বিনিয়োগ প্রস্তাব আগের অঙ্কগুলিকে ছাপিয়ে যায় কি না, তা নিয়ে আগ্রহ রয়েছে প্রশাসনের মধ্যেই। সরকারি ভাবে চূড়ান্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হলেও, এই সম্মেলনে রাজ্যকে বিনিয়োগের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় যে খামতি রাখা হবে না, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তারা।
যুক্তি হিসাবে রাজ্যের আর্থিক অগ্রগতি তথা অভ্যন্তরীণ গড় উৎপাদন বা জিএসডিপি-র উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে সামনে রাখা হচ্ছে। নবান্ন দাবি করছে, চলতি (২০২৪-২৫) আর্থিক বছরের বাজেট অনুযায়ী রাজ্যের জিএসডিপি পৌঁছোতে পারে ১৮.৭৯ লক্ষ কোটি টাকায়। ফলে অভিজ্ঞ কর্তাদের একাংশের অনুমান, তা উৎপাদন, তথ্যপ্রযুক্তি, এমএসএমই ইত্যাদি ক্ষেত্রে লাভজনক বিনিয়োগের আশা জাগাবে। সেমিকনডাক্টর এবং গ্লোবাল কেপেবিলিটি সেন্টার (জিসিসি), নতুন উদ্যোগ শুরু (স্টার্ট আপ), ‘ডিফেন্স প্রোকিয়োরমেন্ট’, বস্ত্র এবং চর্মশিল্প সমেত বেশ কিছু নীতি, সম্মেলনে প্রকাশ করে সেই বার্তাকে আরও জোরদার করতে পারে সরকার।
শীর্ষ আধিকারিকদের একাংশের দাবি, এমএসএমই, তথ্যপ্রযুক্তি তো বটেই, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, প্রাণিসম্পদের মতো ক্ষেত্রেও রাজ্যের অগ্রগতি স্পষ্ট। ফলে এই ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকবে। কলকাতায় সেমিকনডাক্টর শিল্প গড়ার ব্যাপারে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক এবং সেখানে এ রাজ্যকে ওই কাজের জন্য বেছে নেওয়াও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। উৎপাদন (প্রতিরক্ষা উৎপাদন-সহ), কৃষি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা, পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রকে তুলে ধরায়, সেগুলিতে বিনিয়োগের আশা করাই যায়। তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর ও ডেউচা পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্প নিয়ে কোনও বার্তা সম্মেলনে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে প্রশাসনের অন্দরে।
সরকারের আশা, এ বারও সম্মেলনে উপস্থিত শিল্পপতি মুকেশ অম্বানী। গত বিজিবিএস-এ তিনি ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ বার তিনি কী ঘোষণা করবেন, সে দিকেও আগ্রহ রয়েছে নবান্নের। আইটিসি-কর্তা সঞ্জীব পুরী, হিরানন্দানি গোষ্ঠীর কর্ণধার নিরঞ্জন হিরানন্দানি, গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট অভিজিৎ দাস, ডালমিয়া গোষ্ঠীর পুনিত ডালমিয়া, বিভিন্ন দেশের বণিকমহলের প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রদূতেরা উপস্থিত থাকতে পারেন।
বিরোধীদের অবশ্য বক্তব্য, বছর বছর বহু টাকা খরচ করে এই বাণিজ্য সম্মেলন করার পরেও রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি বদলায় না। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যেমন, এই সম্মেলন প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘এটা বাৎসরিক উৎসব হয়, একটা কোম্পানিকে ৫০ কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বিদেশে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শালবনিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কারখানার ঘোষণা করেছিলেন। কারখানা কিছুই হয়নি। উল্টে ২০২১ সালের পরে ডাবরের কারখানা বন্ধ হয়েছে।’’
কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘আমার প্রশ্ন, এত বছরে এতগুলি বাণিজ্য সম্মেলন করেমোট কত টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব পাশ হল এবং সেই প্রস্তাবের মধ্যে কত টাকার বিনিয়োগ বাস্তবে রূপায়িত হল?’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীরও মন্তব্য, ‘‘বাণিজ্যসম্মেলন করে কত টাকার বিনিয়োগ বাস্তবে এসেছে, তা নিয়ে শ্বেতপত্র দিক রাজ্য সরকার।’’
রাজ্যের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘‘কবে, কোথায় কেন্দ্র বা কোন রাজ্য সরকার এই রকম শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে?’’ চন্দ্রিমার কথায়, ‘‘কাগজে-কলমে রাজ্য সরকার আগের সম্মেলনগুলির কথা জানিয়েছে। এ বারেও জানাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ রাজ্যে শিল্পের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা বিরোধীদের চোখে পড়ে না।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)