সাধারণ যাত্রীদের সিট থেকে জোর করে তুলে দেওয়ার অভিযোগ আছে নিত্যযাত্রীদের বিরুদ্ধে। নিজস্ব চিত্র।
আপনার মোবাইলটা একটু দেবেন দাদা, বাড়িতে একটা ফোন করব। স্বভাবতই প্রশ্ন এল, কিছু সমস্যা হয়েছে? উত্তরে জানা গেল, ‘‘আমার মোবাইলটা পকেট থেকে তুলে নিয়েছে। কী করব বুঝতে পারছি না। ১২ হাজার টাকা দিয়ে নতুন মোবাইল কিনেছিলাম।’’
এমনই আকুতি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরিরত যুবকের। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় ক্যানিং লোকালে ভিড়ের সুযোগে তাঁর পকেট সাফ করে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। এমন অভিজ্ঞতা একা ওই যুবকের নয়। এক ঘণ্টা পর পর এই লাইনে ভিড়ের মধ্যে যাতায়াত করতে গিয়ে এমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। চুরি-ছিনতাই প্রায় নিত্য দিনের ঘটনা। যাত্রীদের অভিযোগ, রেল পুলিশের নজরদারি না থাকায় দিনের পর দিন দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। চোখের নিমেষে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে মহিলাদের গলার হার, কানের দুল-সহ নানা অলঙ্কার। মোবাইল ফোন, টাকা, ঘড়ি, ব্যাগ—কোনও কিছুই বাদ যাচ্ছে না। ক্যানিং লোকালে যাত্রীদের সুরক্ষা বা স্বাচ্ছন্দ্য বলতে কিছুই নেই। শুধু তাই নয়। অভিযোগ আরও গুরুতর। মদ, গাঁজা, হেরোইন পাচার চক্রের অন্যতম বড় মাধ্যম হল এই ক্যানিং লোকাল।
টিটাগড়ে লোকাল ট্রেনের কামরায় বিস্ফোরণের পরেও নড়েচড়ে বসেনি প্রশাসন। আতঙ্ক পুষেই যাতায়াত করতে বাধ্য হন ক্যানিং শাখার যাত্রীরা। সন্ধ্যা নামলেই ক্যানিং, তালদি, ঘুটিয়ারিশরিফ, বেতবেড়িয়া, পিয়ালি-সহ বিভিন্ন স্টেশন চলে যাচ্ছে মদ-গাঁজা কারবারিদের দখলে। অধিকাংশ সময়ে স্টেশনগুলিতে দেখা মেলে না জিআরপি বা আরপিএফ-এর, অভিযোগ এমনই।
শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার প্রান্তিক স্টেশন হল ক্যানিং, যা ‘গেটওয়ে অফ সুন্দরবন’ বা ‘সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার’ নামে পরিচিত। ক্যানিং, গোসাবা, বাসন্তী, সন্দেশখালি, মিনাখাঁ-সহ সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম হল ক্যানিং স্টেশন। এই রেল লাইন দিয়ে শহর ও শহরতলিতে প্রতি দিন যাতায়াত করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। লোকাল ট্রেনের ভেন্ডার বগিতে রমরমিয়ে চলে গাঁজার আসর। কেউ কেউ গাঁজার পুরিয়া বিক্রিও করে ওই কামরায় উঠে। এ ব্যাপারে কারও কিছুই করার থাকে না, চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া। ভেন্ডারের পাশেই মহিলা কামরা। সেখানে কখনও কখনও রেল পুলিশ থাকলেও তাদের নজর থাকে অতিরিক্ত মাল বোঝাইকারীদের দিকে। কারণ, তাদের কাছ থেকে রেল পুলিশ ‘তোলা’ আদায় করে বলে অভিযোগ। ক্যানিং থেকে সোনারপুর পর্যন্ত কোথাও মাল ওজন করার কোনও যন্ত্র নেই। ফলে লোকাল ট্রেনে প্রতিদিন কত মাল অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে যাচ্ছে, তার কোনও পরিমাপ হয় না। এর ফলে সরকারের রাজস্ব যেমন ক্ষতি হচ্ছে, অন্য দিকে ‘তোলা’ আদায়ের দিকেই বেশি নজর থাকছে রেল পুলিশের, উঠছে এমন অভিযোগ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে ক্যানিংকে ‘মডেল স্টেশন’ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। অভিযোগ, আজও মডেল স্টেশন বানানোর কোনও কাজই হয়নি। সন্ধ্যা হতেই অন্ধকারে ঢেকে যায় ক্যানিং স্টেশন। যার সুযোগ নিয়েই দুষ্কৃতীরা টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের পকেট থেকে মোবাইল, টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পলিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে আসা ক্যানিং লোকালের মহিলা কামরায় কোনও পুলিশ না থাকায় পুরুষ যাত্রীরাও যথেচ্ছ হারে উঠে পড়ে। এই নিয়ে কোনও মহিলা প্রতিবাদ করলে শোনা যায় নানা কটূক্তি। কিছু নিত্যযাত্রী আসন দখল করে তাস খেলতে ব্যস্ত থাকে। অন্য কোনও নতুন যাত্রী ওই সব আসনে বসতে গেলে তাঁদের জোর করে উঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকী, অনেক ক্ষেত্রে মারধরের হুমকিও শুনতে হয় বলে অভিযোগ।
ক্যানিং লোকালের এক নিত্যযাত্রী শম্ভু মান্না বলেন, ‘‘ট্রেনে যাত্রীদের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। আমি অসুস্থ পুত্রবধূকে নিয়ে কলকাতায় হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। এমন সময়ে কয়েক জন উঠে আমাদের আসন ছেড়ে দিতে বলে। আমি তাদের মিনতি করে বলি, আমি বয়স্ক মানুষ। পুত্রবধূ অসুস্থ। আমাদের দয়া করে বসতে দিন। কিন্তু ওরা কথা শুনল না। কার্যত হাত ধরে উঠিয়ে দিল। বাধ্য হয়ে পুত্রবধূকে পাশের মহিলা কামরায় তুলে দিয়ে আমি অন্য কামরায় দাঁড়িয়ে এলাম।’’
প্রতিদিন শিয়ালদহ থেকে ফল নিয়ে এসে বাসন্তীতে বিক্রি করেন মিনু কয়াল। তিনি বলেন, ‘‘কোনও দিন যদি ফলের ঝাঁকাটা একটু বড় হয়ে যায়, তা হলে আর উপায় নেই। রেল পুলিশ জোর করে টাকা নেওয়ার জন্য। টাকা দিতে অস্বীকার করলে মাল নামিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। অথচ ভেন্ডারে জুয়ার আসর বসে। অনেকে গাঁজা খায়। এমনকী, গাঁজার বিক্রিবাট্টা পর্যন্ত হয়। সে দিকে পুলিশের নজরই পড়ে না।’’
ক্যানিং হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘ক্যানিং লোকালে যাতায়াত করাটা এখন রীতিমতো আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দিন আগে আমার একটা দামি মোবাইল হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে যায় এক দুষ্কৃতী। রেল পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি।’’
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার অভিযোগ, সদ্যোজাত শিশু থেকে নারীপাচার চক্রের একটা সক্রিয় অংশ এই ক্যানিং ট্রেনকে ব্যবহার করে। কয়েক মাস আগে ট্রেনের কামরায় একটি আসনের তলা থেকে একটি প্লাস্টিকের থলির মধ্যে একটি সদ্যোজাত শিশুকে উদ্ধার করে রেল পুলিশ। তাকে ক্যানিং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করে। স্টেশন থেকে ক’দিন আগে রক্তাক্ত এক যুবককেও উদ্ধার করা হয়েছিল।
অভিযোগ উড়িয়ে রেল পুলিশের দাবি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোটখাটো চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ সময়েই অভিযোগ এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy