Advertisement
E-Paper

রহিমপুরের পুজোর রসিদ ওড়ে শিবপুরে

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ

রবিশঙ্কর দত্ত

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:০৪
বাড়ির বাগান দেখভাল করছেন কবিতা। নিজস্ব চিত্র

বাড়ির বাগান দেখভাল করছেন কবিতা। নিজস্ব চিত্র

লাউমাচার ফাঁক দিয়ে কাস্তের ফলার মতো চাঁদ। হয়ত বা ঝিনুকের ফালির মতো।


শীতলষষ্ঠীর রাতে তারই মুক্তো-ভাঙা আলো এসে পড়েছে উঠোনটায়। একেবারে নীল বেনারসির মতো তারা- ছাপা আকাশ।
সব তারাকে চেনেন কি কবি? কালপুরুষ? অরূন্ধতী, স্বাতী বা সপ্তঋষিকে?


পুরনো বাড়ির বারান্দার খুঁটি ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে হাসলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা। মাথার বউটুপিটা টেনে নিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে বললেন, ‘‘আমি আসলে কবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই বয়স পর্যন্ত সে নাম হারিয়ে গিয়েছে। নাম থেকে ‘তা’ খসে এখন শুধু কবি। ঠিক ওইরকমই মাথা থেকেও একেক করে এদের নাম হারিয়ে যাচ্ছে।’’ আরও রাত হলে পাশের পুকুরটায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আসে শোওয়ার ঘরে। কবিতা চেনেন, বলেন, ‘‘ঝরাপাতায় জল নষ্ট হলে মাছের দল লাফিয়ে ওঠে। কুয়াশায়ও কষ্ট হয় ওদের।’’ বাজারে তাই গ্রাসকার্প, সিলভারকার্প আর আমেরিকান রুইয়ের ছড়াছড়ি। ৮০-৮৫ টাকা কিলো।


রাত আরও বাড়লে ঢেউ ভাঙার মতো করে পশ্চিমের বাথরুমের গা ঘেঁষে বাড়িতে ঢোকে শিয়ালের হুল্লোড়। পাড়া থেকে আসা বাটি-বাটি গোটাসিদ্ধ ঢাকা দিতে দিতে ধেড়ে ধেড়ে বেজির দিকে ফুট কাটেন কৈশোরে মৌমাছির চাকে পাটকাঠি ঢুকিয়ে মধু খাওয়া কবিতা। রাতের এই আকাশ, মাঠঘাট ভাসানো জ্যোৎস্না, কাঞ্চনফুলের নেশা ধরানো গন্ধ কিংবা ঘুটঘুটে অমাবস্যায় নৈঃশব্দ- ভাঙা শিয়ালের হুল্লোড়—এ সবের সঙ্গে তাঁর সাতষট্টি বছর কেটে গিয়েছে। কম তো নয়, তাতেই তো একটু একটু করে এই রকম অনেক কিছু হারিয়েছে। সময় আবার জুড়ে দিয়েছে অনেক কিছু। এই আসা-যাওয়ার মধ্যে তাঁদের সঙ্গে রয়ে গিয়েছে তিনশ’ বছরের ঠাকুরদালান, সকাল-দুপুর পাখির আনাগোনা, কাঠবিড়ালির বায়না, গাছগাছালির মনখারাপ, পড়শির সুখ-দুঃখ।


আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারির মধ্যে একখানা সোনাঝুরি কোথায় দাঁড়িয়ে, চোখ ফিরিয়েই ধরতে পারেন তিনি। এখানে লালমাটির গাছ? কবিতা বলেন, ‘‘বাবার শখ। এ দিক ও দিক থেকে এ সব কুড়িয়ে-বাড়িয়ে জড়ো করতেন। ওই যে পিছনের দিকে দেখা যাচ্ছে, ও তো মহুয়া।’’


গ্রাম-জীবনে এ সবই আছে শুধু আড়াল নেই এখনও। হাওড়া শহর থেকে ঘণ্টা দুইয়ের বাসযাত্রা শেষে উদয়নারায়ণপুর যেতে শিবানীপুর বাসস্টপ। তারপর কবিদের ছবির মতো গ্রামের দিকে এগোলে নতুন লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন তাঁদেরই কোনও প্রতিবেশী, হয়ত তাঁদেরই কোনও পড়শির মেজো বউ, কাকার ছোট ছেলে। হয়ত ‘ওই যে রাস্তা নীচে গড়িয়েছে, সে দিক এগোলেই দিদিদের বাড়ি। একেবারে সোজা’— বলে এগিয়ে দেবেন তাঁরই কোনও ছাত্র। সেই মতো এগোলে বিরাজলক্ষ্মী গার্লস স্কুলের বিশাল বাড়ি। তার মাঠে সার দেওয়া সরকারের দেওয়া সাইকেল। দু’চারটে স্কুটিও।


মাঝে দামোদর বইছে। এক পাশে হুগলি আর এক পাশে হাওড়ার এই উদয়নারায়ণপুর। এ সময় জল একেবারে তলায়। বর্ষার সময় তার দু’পাশ থাকে জলের তলায়।

এখন তাতে জল নেই। তাতে কী তার দু’পাশ জুড়ে বালি-মেশানো মাটি তো স্বর্ণগর্ভা। ধানে ধান, আলুতে আলু। ধান উঠেছে। এখন গোড়ালি সমান সবুজ ঝাড় হয়ে থাকা জমির পর জমির নীচে ‘সোনার তাল’। কুমোরটুলির শিল্পী যেমন মহালয়ার মুখে দেবীমূর্তির চারপাশ ঘুরে ঘুরে নিজের সৃষ্টি দেখেন, সেইরকম আলুর খেতে ঘুরছিলেন ভদ্রলোক। ধার দিয়ে কী জল দিয়েছেন? হাতের তালুতে সূর্যে আড়াল দিয়ে এগোতে এগোতে জবাব দিলেন, ‘‘হ্যাঁ গো। শুধু দিলেই হবে না। নজর না করলে মরবে যে। সবাই তো সমান নিতে পারে না। জ্যোতির মাঠে চোখ না রাখলে গেল।’’ হিমঘরে পুজো হয়েছে। তার দরজা খোলা পর্যন্ত ক’দিন দেখে রাখতে হবে। মাখনের মতো আলু ফের উঠবে ফাল্গুনের কুড়ি-বাইশ নাগাদ। এক-একটা এক-দেড় কিলোরও হয়। একেবারে ছোটগুলো তো ঝুরোমাটিতেই পড়ে থাকে। কেউ কেউ কুড়িয়ে নেয়। মাঝেমাঝে হাতির মাথার মাপের বাঁধাকপি, ভাতের হাঁড়ির মতো ফুলকপি।


পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কানানদীতে বস্তা ফেলে বাস-রাস্তায় যাতায়াতের ব্যবস্থা হয়েছে। তারকেশ্বর থেকে আমতা যাওয়ার একটা বাস হু হু করে এগিয়ে এল। এয়ার হর্নে কানে হাত দিলেন প্রৌঢ়। চাষবাসের সুখসমৃদ্ধির কথা বলছিলেন। দামোদর ভাসায় ঠিকই তবে বাকি সময় এ জমি নিজেকে উজাড় করে। এ সবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় মার্টিন রেলের সময় থেকে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, বাবার সঙ্গে সেই ট্রেনে হাওড়া থেকে জাঙ্গিপাড়া। তারপর হেঁটে প্রায় ১২ মাইল পথ। একমুখ হেসে বললেন, ‘‘পিচরাস্তা হওয়া থেকে বাসেই যাতায়াত।’’


তার সমান্তরাল শিবপুরের ছোট পিচরাস্তা। বছর তিন-চার তৈরি হয়েছে। সকালে-বিকেলে এখন এই ভিতরের রাস্তাও পেরতে হয় দু’ধার দেখে নিয়ে। এখন এ দিক ও দিক বাইক ছুটছে। ভরদুপুরে সেই মোলায়েম পিচরাস্তায় গাড়ি চড়ে হুশ করে নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন যুবক। মাঝের আসনে হাসিহাসি দুটি মুখ। পিছনে রাখা টোপর, বড় দুই ব্যাগ। তার হাওয়ায় পিছন পিছন উড়ছে গদা হাতে ভীমের ছবি দেওয়া চাঁদার রসিদ। হুগলির রহিমপুর পশ্চিমপাড়ার ভীমপুজোর জন্য ১০ টাকা। মোটা হরফে লেখা ক্লাবের নাম তরুণ-কৃষক সঙ্ঘ, উদ্যোক্তাদের নামও।


ওই রাস্তাই সোজা গিয়েছে উদয়নারায়ণপুর বাজার। একেবেঁকে এগিয়ে গেলে ডান হাতে নতুন শ্মশান, বাঁদিকে বহু পুরনো মন্দির। সরকারি ঘরের দেওয়ালে নীল-সাদায় পঞ্চায়েত লিখেছে, ‘যদি থাকতে চাও সুস্থ সবল দেহে শৌচাগার ব্যবহার কর নিজ গৃহে’। শিবপুরে জল গেছে পাড়ায়। বলেছিল বাড়িতেও যাবে। তবে রাতবিরেতে ডাক্তার নেই গ্রামে। কলকাতার ডাক্তার তো থাকেন না।


এই রাস্তাতেই ‘চিল্ড্রেনস প্যারাডাইস’। গাঁয়ের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। পাশে একটা বাড়ির গায়ে লেখা ‘আঁকা আর গানের স্কুল’। এখন ছুটি। তবে বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে মন্দিরের মাঠে। সেখানে বড় ছেলেদের ‘অর্ডার’ পৌঁছে দিতে অনলাইন কোম্পানির ব্যাগ ঝোলানো মোটরবাইক।
পাকা রাস্তার ওপারে রায়পাড়া। ধান, আলুতে বোঝাই। পিচ রাস্তা শেষ হতে গ্রামের ভিতরে ঢুকেছে কংক্রিটের চওড়া রাস্তা। গাছে ঝুলছে তৃণমূলের পতাকা, বিজেপির প্রতীক। কৃষিঋণ পুরোপুরি মকুবের দাবিতে সিপিএমের হাতে লেখা পোস্টার। তবে সে সব নিয়ে টানাটানি কানে আসেনি। রায়পাড়ার পথে খোঁজ করতে ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, ‘‘রেশন আছে। কিন্তু এই যে স্বাস্থ্যসাথী, তাতে গলদ নাই তো? এত মানুষকে দিতে পারবে?’’


এ রাস্তা আঁকনা গিয়েছে। কাঁড়ারপাড়া থেকে এগিয়ে বাঁদিকের মাঠে ‘সোনার বাংলা নিউস্টার ক্লাব’-এর সরস্বতী মণ্ডপ। সামনে দৈত্যাকার সাউন্ড সিস্টেম। বাঁশের গায়ে ঝুলছে লেখা— ‘মাঠে ক’দিন গরু বাঁধা নিষেধ।’ তবে সে নিষেধে যায়আসে না বক, বুলবুলি, মাছরাঙার। চাষের জমি, মাছের পুকুর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় মোহনচূড়, বসন্তবৌরি।

Howrah udaynarayanpur Gram Darshan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy