E-Paper

‘রাতে ফোন এল, বাঘে নিয়েছে স্বামীকে’

আবুর গত বছর সঙ্গীদের নিয়ে নিজের নৌকা করে গিয়েছিলেন কাঁকড়া ধরতে। নদীতে গন (জোয়ার) আসার পরে জঙ্গলের ধারে কাদায় জাল পুঁতে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২৮
হরিপদ দাস, কৈখালি আশ্রম।

হরিপদ দাস, কৈখালি আশ্রম। নিজস্ব চিত্র।

দেউলবাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মাতলার শাখানদী ঠাকুরান। নদীর এক দিকে বাড়ি মহিমা মোল্লার। অদূরে চিতুরির জঙ্গল। সেখানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের রাজ্যপাট।

নদী পেরিয়ে যখন-তখন গ্রামে বাঘের আনাগোনা কিংবা রুজির টানে বাঘের ডেরায় গিয়ে ঘরের লোকের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া খুব সাধারণ ঘটনা দেউলবাড়িতে। এমন ‘সাধারণের’ ধাক্কাতেই মহিমাদের জীবন ভেসে যায়। বন দফতরের হয়ে গভীর জঙ্গলে ম্যানগ্রোভের চারা সংগ্রহের কাজ করেন মহিমা। আর স্বামী আবুর আলি মোল্লার কথা উঠলেই ভাসতে থাকেন...চোখের জলে।

আবুর গত বছর সঙ্গীদের নিয়ে নিজের নৌকা করে গিয়েছিলেন কাঁকড়া ধরতে। নদীতে গন (জোয়ার) আসার পরে জঙ্গলের ধারে কাদায় জাল পুঁতে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। মহিমার কথায়, ‘‘নৌকা ভাটায় রাখা ছিল। পরের গনে আমার স্বামীর ফেরার কথা। বিকেলে ফোনে কথাও হল। রাতে ওর সঙ্গের লোকেরা ফোন করে জানাল, স্বামীকে বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছে। ওর দেহ আর জঙ্গল থেকে আনা যায়নি। তার পর থেকে আমার এক ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে শ্রমিকের কাজ করে।’’

এখানে মানুষ এ ভাবেই বাঁচেন।

সুন্দরবনের মৈপীঠ, দেউলবাড়ি, কৈখালি আশ্রমের প্রত্যন্ত গ্রামে ‘বাঘের দেখা পাওয়া’ মানে ঠিক কী, সেটা মাঝনদীতে লঞ্চে বসে বাঘ দেখে উল্লসিত হওয়া কিংবা না-দেখে হতাশ হওয়া পর্যটকদের পক্ষে বোঝা কঠিন। মূলত মৎস্যজীবীদের এই সব গ্রামে কোনও পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যকে নৌকা থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছে বাঘ। কেউ বাঘের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে এলেও পঙ্গু। কেউ কুড়িয়ে পেয়েছেন স্বজনের বাঘে-খাওয়া দেহ।

কুলতলির কৈখালি আশ্রমে ছোট্ট মাটির বাড়িতে এক রকম বিছানায় শুয়েই দিন কাটে হরিপদ দাসের। গত বছরের জুলাইয়ে বাঘের কামড় খেয়ে আট মাস কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন হরিপদ। এক সময়ের টানটান চেহারা এখন শীর্ণকায়। বাঘ কামড়েছিল গালে। সেই গালের চামড়া হাঁ হয়ে দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়েছে। বিকৃত হয়ে গিয়েছে মুখমণ্ডল। হরিপদ বলছিলেন, ‘‘রাতে জঙ্গলে গিয়েছিলাম। সকালের খাবার খাব বলে নৌকা থেকে নেমে মুখ-হাত ধুচ্ছিলাম। সেই সময়ে বাঘ ঝাঁপাল আমার উপরে। প্রাণপণে বাঘের থাবা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখতে রাখতে এক সময়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। বাঘ আমার গাল কামড়ে ধরল। শেষে বাঘের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিই। বাঘটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পালাল। গালের মাংস খুবলে বেরিয়ে এসেছিল। এখন শুধু তরল খাবার খেতে পারি।’’

কুলতলির কাঁটামারির বাসিন্দা রবি সর্দার জানালেন, দু’-তিন সপ্তাহ আগে বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছে তাঁদের প্রতিবেশী শম্ভু সর্দারকে। গত জানুয়ারিতে রবির বাবা অজয় সর্দারেরও প্রাণ গিয়েছে বাঘের ডেরায় ঢুকে। রবি বলেন, ‘‘বাঘ এক বার যাকে নিশানা করে, তাকেই আক্রমণ করে। বাবার ক্ষেত্রে ঘটনাটা তেমন হয়েছিল বলে শুনেছি। বাবার সঙ্গে এক বয়স্ক মানুষ ছিলেন। বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি কাদায় আটকে পড়েন। বাবাকে মেরে বাঘ তাঁর দিকেও এগোচ্ছিল। সেই সময়ে অন্যেরা তাড়া করলে বাঘ পালায়। ভয়ঙ্কর অবস্থায় বাবার দেহ উদ্ধার হয়েছিল।’’

প্রতি পদে বিপদ। তবু জঙ্গলে না ঢুকে উপায় নেই সুন্দরবনের গরিব মৎস্যজীবীদের। তাঁরা জানান, নদীতে ভুটভুটি আর লঞ্চের চলাচল বেড়ে যাওয়ায় মাছ-কাঁকড়ার দল নদীর খাঁড়ির দিকে সরে আসে। তাই তাঁরাও বাধ্য হন সেই দুর্গম খাঁড়িতে বাঘ আর কুমিরের আস্তানায় ঢুকতে। জোয়ারের সময়ে নৌকা কিংবা তালগাছের গুঁড়ির তৈরি ডোঙায় চড়ে তাঁরা ঢুকে পড়েন খাঁড়ির ভিতরে। তার পর নদীর চরে জাল পেতে জঙ্গলে ঘেরা খাঁড়িতে অপেক্ষা। তিন দিন, চার দিন। এক সময়ে মাছ-কাঁকড়া তুলে, জোয়ার এলে আবার নৌকা ছেড়ে দেওয়া। বিশেষ করে শীতের সময়ে বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা থাকে। তাই দু’পয়সা বাড়তি লাভের আশায় হাতে প্রাণ নিয়েই কাঁকড়া ধরতে যাওয়া।

উপায় নেই। পেট চলবে কী করে? কিন্তু এক জোয়ারে যে মানুষ নৌকা ভাসাল, সে ফিরবে তো পরেরজোয়ারে? (চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sundarbans

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy