আমানতকারীদের টাকা তিনি ফিরিয়ে দিতে চান। নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর নানা সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েই সেই কাজ অনেকটা এগোনো যায়। কিন্তু ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা উদ্যোগী না হলে সেই সম্পত্তিও ‘লুঠপাটের দলে’র হাতে বেদখল হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন! ‘লুঠপাটের দল’ বলতে তিনি যে শাসক দলকেই ইঙ্গিত করছেন, তা নিয়ে সংশয় দেখছে না বিরোধীরা। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য প্রকাশ্যে সারদা-কর্তার এমন বক্তব্য নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ।
সারদা-কাণ্ডে জেলবন্দি সুদীপ্তের নিজের জবানিতে কিছু কথা শুক্রবার সম্প্রচারিত হয়েছে এবিপি আনন্দ চ্যানেলে। সারদা-কর্তা নিজে যাকে ‘এক মৃত্যুকালীন মানুষের জবানবন্দি’ বলে অভিহিত করেছেন। সেখানেই সুদীপ্তকে বলতে শোনা গিয়েছে, তাঁর প্রচুর সম্পত্তি এখনও রয়ে গিয়েছে। যেগুলো এখনও ইডি-র নাগালের বাইরে। এর অনেক কিছুই নথিভুক্ত করা নয়। এই সম্পত্তিই বেহাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সারদা-কর্তা। সংবাদ চ্যানেলের কাছে তাঁর আবেদন, “আপনারা যদি ইডি-কে একটু পুশ করেন। তা হলে আজ হোক বা কাল হোক, কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয়ই একটা পদক্ষেপ করবে। তা হলে সবাই মূল টাকাটুকু (আমানতের মূল অঙ্ক) ফেরত পেয়ে যাবে।” সারদা-কর্তার আরও বক্তব্য, “সারদায় সমস্ত সম্পত্তি, বিশেষ করে যে সমস্ত এগ্রিমেন্ট হয়ে আছে, যেগুলো রেজিস্ট্রি হয়নি, সেগুলো যেন, মানে লুঠপাটের দল যেন না খায়!”
এর আগে নানা মামলায় আদালতে হাজিরার সময়েও একই আশঙ্কা বিচারকদের সামনে প্রকাশ করেছিলেন সুদীপ্ত। তবে সরাসরি ‘লুঠপাটের দলে’র কথা এ ভাবে বলেননি তিনি। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের জল যখন অনেক দূর গড়িয়েছে এবং ফেঁসে যাচ্ছেন শাসক দলের রাঘব-বোয়ালরা, তখন টিভি চ্যানেলে সুদীপ্তের মুখে এই কথা আসলে কেলেঙ্কারির ভয়াবহতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছে বিরোধীরা। তা ছাড়া, সুদীপ্ত মন্তব্য করেছেন, তাঁর সংস্থার অনেক লোক সারদার ঘটনায় লাভবান হয়েও নিজেদের ‘গা বাঁচিয়ে’ নিয়েছে। যারা লক্ষ লক্ষ টাকা মাইনে পেয়েছে, তারা এক দিনের জন্যও তাঁকে সতর্ক করে বলেনি যে, এই কাজটা ঠিক হচ্ছে না উষ্মা এবং আক্ষেপ সুদীপ্তের। ‘প্রসিড্স অফ ক্রাইমে’র টাকায় মাইনে নিয়েও অনেকে ‘সরে গিয়েছে’ বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। তাঁর এই মন্তব্যের মধ্যেও শাসক দলের প্রতি কোনও ভাবে ইঙ্গিত রয়েছে কি না, জল্পনা শুরু হয়েছে শাসক এবং বিরোধী, দুই শিবিরেই!
সারদা-কর্তার সম্পত্তি শাসক দলের লোকজনের কাছে হাতবদল হয়ে যাচ্ছে বলে আগেই সরব হয়েছিল বিরোধীরা। সুদীপ্তের এ দিনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ফের বলেছেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রীকে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলাম, সারদা-কর্তার সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। শাসক দলের কাজকর্মের জন্যই এই আশঙ্কা ছিল। তদন্ত প্রক্রিয়ায় যত সময় লাগবে, সম্পত্তি বেদখল হওয়ার সুযোগ ততই তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় সংস্থা যাতে বিষয়টি দেখে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সে কথা আমরা বলে এসেছি।” সুদীপ্ত গ্রেফতার হওয়ার পরেই সূর্যবাবু দাবি করেছিলেন, সারদা-কর্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। টিভি চ্যানেলে তাঁর মুখে এ দিন যে ভাবে ‘মৃত্যুকালীন মানুষের জবানবন্দি’র কথা শোনা গিয়েছে, তার পরে সেই দাবির পুনরাবৃত্তি করেছেন সূর্যবাবু। তাঁর কথায়, “সুদীপ্ত অনেক কিছু বলে দিলে বিপদে পড়বে শাসক দলই। তাই আবার বলছি যে, ওঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার।”
সারদা মামলা নিয়ে যিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, কংগ্রেসের সেই নেতা আব্দুল মান্নানেরও দাবি, “গোটা প্রতারণা-চক্র পরিচালনা করেছিল তৃণমূল। সুদীপ্ত সেন তাদের ঠিকই চিনেছেন! তিনি যে ঠিক কথা বলছেন, তৃণমূলের সরকার নিজেরাই সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। জেলে সুদীপ্তর সঙ্গে কথা বলতে ইডি-কে তারা বাধা দিয়েছে। তাদের ভয়, সুদীপ্ত যদি অনেক কিছু বলে দেন!” আবার বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “এক সময় উনি লুটেরাদের পক্ষে ছিলেন। কারণ তখন ওঁর মনে হয়েছিল, এরা ওঁকে বাচাবে! কিন্তু এখন বুঝেছেন, সে আশা নেই। তাই ভাবছেন, লুটেরাদের হাত থেকে সম্পত্তি বাঁচিয়ে যদি টাকা ফেরত দেওয়া যায়!”
শাসক দল অবশ্য সুদীপ্তের আশঙ্কা বা অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “সুদীপ্ত সেন কখন, কার কথায় কী বলেন, তা-ই নিয়ে কোনও মন্তব্যই করতে চাই না।”
তৃণমূল মুখে গুরুত্ব দিতে না চাইলেও সুদীপ্ত কিন্তু তাঁর সম্পত্তি এবং সে সব লোপাটের অভিযোগের তথ্য ইতিমধ্যেই তদন্তকারীদের দিয়েছেন। যেমন, ইডি এবং সিবিআইয়ের জেরায় তিনি বারুইপুর অফিসের ম্যানেজার অরিন্দম দাস ওরফে বুম্বার বিরুদ্ধে সারদার সম্পত্তি লোপাটের অভিযোগ করেছিলেন। বারুইপুর এবং ইএম বাইপাস এলাকায় কয়েক বিঘা জমি কেনার জন্য সারদার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তা বুম্বা নিজের নামে করে নেয় বলে অভিযোগ। শুধু বুম্বা নয়, এক সাংসদের বিরুদ্ধেও অগ্রিম বাবদ কয়েক কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ করেছেন সুদীপ্ত। ওই সাংসদ নানা সময় বুম্বার মাধ্যমে ৫-৭ কোটি টাকা নানা প্রকল্পের জন্য জমি কেনা বাবদ অগ্রিম নিয়েছিলেন বলে
অভিযোগ। কিন্তু পুরো টাকা না দেওয়ায় ওই সব সম্পত্তি রেজিস্ট্রি হয়নি। সেই সময় সুদীপ্ত গোয়েন্দা-কর্তাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, ওই সব সম্পত্তি নানা লোক বেআইনি ভাবে নিজেদের নামে করে নিচ্ছে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের কিছু সম্পত্তির কথাও তদন্তকারীদের কাছে উল্লেখ করেছেন তিনি। ওই সম্পত্তির হদিস করার চেষ্টা হচ্ছে। সিবিআইয়ের এক তদন্তকারীর বক্তব্য, সুদীপ্তের অভিযোগের ভিত্তিতে বুম্বাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল। কিন্তু সে এখন ফেরার। সল্টলেকে দু’টি বাড়ি কেনার জন্য সুদীপ্ত প্রায় দেড় কোটি টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি ভাবে ওই বাড়ির দখল পাননি। ২০১০ সালে ওই বাড়ি দু’টি তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন। গড়িয়াহাটের বাসিন্দা একটি বাড়ির মালিকের কথায়, “সুদীপ্তবাবু আমাকে কয়েক দফায় এক কোটি ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু দেড় কোটি টাকায় কিনবেন বলে ওই বাড়ির দাম ধার্য হয়েছিল। উনি পুরো টাকা দিতে পারেননি বলে রেজিস্ট্রি হয়নি।”
সুদীপ্তের দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ালির কথায়, “শুধু বাড়ি নয়। উনি বহু সম্পত্তিতেই টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু অধিকাংশই পুরো টাকা না দেওয়ায় সেই সম্পত্তি সারদার হাতে আসেনি।”
এ সব তথ্য পিয়ালি ইডি-র তদন্তকারীদেরও জানিয়েছেন। তাঁর আরও অভিযোগ, ২০১১-১২ সালে সুদীপ্ত একাধিক কর্মচারীর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ করতেন। বিশেষ করে, সারদার ডায়মন্ড হারবার অফিসের এক ম্যানেজার ও সারদা গার্ডেনের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল। সারদার টাকায় তাঁরা নানা জায়গায় বেনামে সম্পত্তি কিনেছিলেন বলে অভিযোগ। সুদীপ্তের এক হিসেবরক্ষকের বক্তব্য, “সেনবাবু অগ্রিম বাবদ বিভিন্ন সম্পত্তিতে প্রায় ২০০ কোটি বিনিয়োগ করেছিলেন। ওই সব বিষয়ে সমস্ত কাগজপত্র সারদার মিডল্যান্ড পার্কের
অফিসে ছিল।” ওই হিসেব রক্ষকের অভিযোগ, “শাসক দলের একাধিক নেতার চাপে সুদীপ্ত নানা সম্পত্তিতে অগ্রিম বাবদ বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু পরে আর ওই সম্পত্তির দখল পাননি।” তাঁর আরও অভিযোগ, ওই সংক্রান্ত বহু কাগজপত্রও পরে গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এখনও তা ইডি বা সিবিআই উদ্ধার করতে পারেনি। তদন্তকারীদের বক্তব্য, সুদীপ্তর স্মৃতিশক্তি প্রখর। তার
জোরেই তিনি বহু তথ্য ইডি-কে দিয়েছেন এবং আরও তথ্য দিতে চান বলে আদালতের অনুমতি নিয়েছেন।