Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
পালানোর আগে পরামর্শ

মুকুল-শুভেন্দুর সঙ্গে সুদীপ্তর বৈঠক, দাবি করলেন চালক

কলকাতা ছাড়ার আগে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মুকুল রায়ের বৈঠক হয়েছিল বলে ইডি-কে চিঠি লিখেছিলেন কুণাল ঘোষ। এ বার ওই বৈঠকের আরও এক জন প্রত্যক্ষদর্শী পেয়ে গেল সিবিআই। নাম অরবিন্দ সিংহ চৌহান। সুদীপ্তের বিশ্বস্ত সহচর। গত বছর কলকাতা ছেড়ে পালানোর সময় তিনিই ছিলেন সারদা কর্তার গাড়িচালক। তিনিই সুদীপ্তদের কাশ্মীরে পৌঁছে দেন। পরে সোনমার্গ থেকে সুদীপ্ত ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অরবিন্দকেও গ্রেফতার করে পুলিশ।

সিবিআই অফিসের বাইরে সুদীপ্ত সেনের গাড়ি চালক অরবিন্দ সিংহ চৌহান (বাঁ দিকে) এবং আইনজীবী বালোটিয়া। মঙ্গলবার শৌভিক দে ও শুভাশিস ভট্টাচার্যের ছবি।

সিবিআই অফিসের বাইরে সুদীপ্ত সেনের গাড়ি চালক অরবিন্দ সিংহ চৌহান (বাঁ দিকে) এবং আইনজীবী বালোটিয়া। মঙ্গলবার শৌভিক দে ও শুভাশিস ভট্টাচার্যের ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৯
Share: Save:

কলকাতা ছাড়ার আগে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মুকুল রায়ের বৈঠক হয়েছিল বলে ইডি-কে চিঠি লিখেছিলেন কুণাল ঘোষ। এ বার ওই বৈঠকের আরও এক জন প্রত্যক্ষদর্শী পেয়ে গেল সিবিআই।

নাম অরবিন্দ সিংহ চৌহান। সুদীপ্তের বিশ্বস্ত সহচর। গত বছর কলকাতা ছেড়ে পালানোর সময় তিনিই ছিলেন সারদা কর্তার গাড়িচালক। তিনিই সুদীপ্তদের কাশ্মীরে পৌঁছে দেন। পরে সোনমার্গ থেকে সুদীপ্ত ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অরবিন্দকেও গ্রেফতার করে পুলিশ।

সতেরো মাস পরে মঙ্গলবার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেলেন অরবিন্দ। জেল থেকে বেরিয়ে বললেন, কাশ্মীর পালানোর আগে গত বছর ৫ এপ্রিল সুদীপ্ত বৈঠক করেছিলেন মুকুল রায়ের সঙ্গে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই বৈঠক হয়েছিল। শুধু মুকুলবাবুই নন। অরবিন্দর দাবি, পালানোর দু’দিন আগে, ৭ এপ্রিল রাতে সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে সুদীপ্তের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল কাঁথির তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীরও। অরবিন্দ জানান, এই দু’টি বৈঠকের কথাই তিনি সিবিআইকে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন।

সল্টলেকের সিবিআই দফতরের বাইরে অরবিন্দ আজ বলেন, “আমি চক্রান্তকারী নই। তাও এত দিন জেলে ছিলাম। চক্রান্তকারীরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কাউকে ধরা হচ্ছে না।”

এ দিন অরবিন্দের বক্তব্য শুনে প্রত্যাশিত ভাবেই সুর চড়িয়েছেন বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “এ তো সবে কলির সন্ধে! রজনী অনেক বাকি। আরও অনেক তথ্যপ্রমাণ ছড়িয়ে আছে, যাতে স্পষ্ট সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূল নেতৃত্ব সরাসরি যুক্ত।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, “মমতা বলেন, বিরোধীরা এবং সংবাদমাধ্যম কুৎসা করছে। কিন্তু অরবিন্দ তো মমতারই ঘনিষ্ঠ সুদীপ্ত সেনের গাড়ির চালক। এ বার তো তৃণমূল নেত্রীকে ব্যাখ্যা দিতেই হবে!”

এ দিন ঠিক কী বলেছেন অরবিন্দ? দুপুরে ফোনে তিনি বলেন, “গত বছরের ৫ এপ্রিল রাত ৮টা নাগাদ আমি সুদীপ্ত সেনকে নিয়ে নিজাম প্যালেসে যাই। সেখানে উপস্থিত মুকুল রায়কে আমি চিনতে পারি। তাঁর সঙ্গে এক ঘণ্টা বৈঠক করেন সুদীপ্ত।” ওই বৈঠকে যে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারও ছিলেন, সে কথাও কবুল করেছেন তিনি। অরবিন্দের দাবি, “এই বৈঠকের দু’দিন পরে, ৭ এপ্রিল রাত ১০টা নাগাদ মিডল্যান্ড পার্কে সারদার প্রধান কার্যালয়ে তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন সুদীপ্ত। ওই কার্যালয়ে আগে থেকেই হাজির ছিলেন সারদার বারুইপুর শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত অরিন্দম দাস (বুম্বা)। তাঁরা দু’জনে এসে শুভেন্দুকে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে যান। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ওই বৈঠক চলে।”

এর আগে মুকুল-সুদীপ্ত বৈঠক সম্পর্কে জেল থেকে চিঠি লিখে ইডি-কে জানিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ। আনন্দবাজারের হাতে আসা ওই চিঠিতে লেখা ছিল: ‘বিপদ দেখে যখন সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছি, সিএমকে বলেছি, তখন মুকুল রায় নিজাম প্যালেসে বৈঠক ডাকল।(৫ এপ্রিল, ২০১৩??) সুদীপ্ত এলেন। গোটাটাই অস্বাভাবিক। রজতবাবুকে রেখেছিল মুকুল। আমি, সোমনাথদা (দত্ত, সারদার সিইও) ছিলাম। অত গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি। কোনও আলোচনা হল না। সুদীপ্ত বললেন, দেরি হয়ে গেল, আমি যাই। মুকুল বলল, ঠিক আছে। রজতদা বলল, আপনার অফিসে গিয়ে কথা বলে নেব।’

কুণালের এই চিঠি আনন্দবাজারে প্রকাশ করার আগে মুকুলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল। তখন তিনি ফোন ধরেননি। এ বার অরবিন্দ একই কথা বলার পরে ফের মুকুলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।” তৃণমূল সূত্রে অবশ্য মুকুলবাবুর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, বিষয়টি বিচারাধীন। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করা উচিত নয়। তৃণমূল সূত্রের আরও বক্তব্য, এক গাড়িচালক কী অভিযোগ করলেন, তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়াও উচিত নয়।

তবে অরবিন্দ যে মামুলি গাড়িচালক নন, সুদীপ্তর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সঙ্গী তা সিবিআই তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, কলকাতা ছাড়ার মাত্র পাঁচ দিন আগে দিল্লি থেকে তাঁকে এ শহরে নিয়ে আসেন খোদ সুদীপ্ত।

দিল্লির নিহালবিহারের এই বাসিন্দা সারদার দিল্লি অফিসে গাড়ি চালাতেন। ২০১০ সালে সারদায় যোগ দেন তিনি। যে কোনও ধরনের গাড়ি চালাতে দক্ষ বছর তিরিশের এই যুবক দ্রুত সুদীপ্তের কাছের লোক হয়ে ওঠেন। সেই সূত্র ধরে মাঝেমাঝেই কলকাতায় আসতে হতো তাঁকে। জেরায় অরবিন্দ জানিয়েছেন, বিশেষ বিশেষ জায়গায় তাঁকে নিয়ে যেতেন সুদীপ্ত। কাজ সেরেই ফের দিল্লিতে ফিরে যেতেন তিনি।

এই রকম কাজের সূত্রেই বার কয়েক কলকাতায় এসে অরবিন্দ চিনে গিয়েছিলেন এখানকার ডাকসাইটে নেতাদের। সিবিআই সূত্রের খবর, জেরার সময়ে নেতাদের ছবি দেখানো মাত্রই নামগুলো গড়গড় করে বলতে শুরু করেন অরবিন্দ। কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওই নেতাদের কয়েক জন কী ভাবে ফোনে তাঁদের ‘গাইড’ করেছিলেন, তা-ও তদন্তকারীদের জানিয়েছেন অরবিন্দ। তাঁর বক্তব্য যাচাই করার জন্য ওই সব নেতার ফোনের ‘কল ডিটেলস’ পরীক্ষা করেছেন তদন্তকারীরা। সিবিআই-এর এক পদস্থ কর্তার কথায়, “অরবিন্দ যে সব নেতার ফোনের কথা বলেছেন, তাঁদের ‘কল ডিটেলস’ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, ঠিক তখনই সুদীপ্তর কাছে ওই নেতার ফোন এসেছিল।”

অরবিন্দ তদন্তকারীদের জানান, পালানো আর ধরা পড়ার পুরো বিষয়টি যে আগে থেকেই ছক কষে করা তা ধীরে ধীরে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়েছে। সোনমার্গে পৌঁছনোর পরে তাঁদের পাক অধিকৃত কাশ্মীরে চলে যাওয়ার জন্য তাঁদের কাছে নির্দেশ এসেছিল বলে অরবিন্দের দাবি। তাঁর বক্তব্য, সুদীপ্ত যেতে চাইলেও দেবযানী ওই নির্দেশ মানতে চাননি। তাঁর জেদেই ওই যাত্রা বাতিল হয়। এর পরেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তাঁরা।

অরবিন্দ আরও বলেন, গ্রেফতার হওয়ার পরে সারদা-কর্তা তাঁকে বলেছিলেন, “সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। কয়েক দিন লকআপে থাকতে হবে। তার পর পুলিশ তোমাকে আর ম্যাডামকে ছেড়ে দেবে। আমাকে ছাড়া হবে আরও কয়েক দিন পরে।”

সিবিআই-এর এক পদস্থ অফিসার জানান, অরবিন্দের দেওয়া তথ্য এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর এই কারণেই এই গাড়িচালকের বয়ানে বিপদের আশঙ্কা করছে তৃণমূলের একাংশ। দু’টি বৈঠকের কথা ছাড়াও অরবিন্দ সিবিআইকে আরও কী কী জানিয়েছেন, তা নিয়েও তাঁরা উদ্বিগ্ন। তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকেও সল্টলেকে ডেকে পাঠান তদন্তকারীরা। শুভেন্দুবাবু অবশ্য বলেছেন, “অরবিন্দ সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলেছে। ওই দিন আমি মিডল্যান্ড পার্ক অফিসে যাইনি। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে।”

অরবিন্দের অবশ্য দাবি, সব কথাই সত্যি। এ দিন জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি সল্টলেকে সিবিআই দফতরেও আসেন। বিকেলে সিবিআই অফিস থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, “বাবার ক্যান্সার। মা শয্যাশায়ী। আমি দিল্লির বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তদন্তকারীরা আপাতত আমাকে কলকাতায় থাকতে বলেছেন।”

এ দিনই সকাল সাড়ে দশটায় সিবিআই দফতরে ডাকা হয় সারদার আইনজীবী নরেশ বালোটিয়াকে। রাত পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তদন্তকারীদের ধারণা, সিবিআইকে সুদীপ্ত যে চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠির খসড়া বানিয়েছিলেন এই নরেশ। সারদার যাবতীয় হিসেবও তিনি দেখতেন বলে সিবিআই সূত্রে খবর। সেই হিসেবপত্র নিয়েই এ দিন তাঁকে দীর্ঘক্ষণ জেরা করা হয়। এ দিন রাত আটটায় সিবিআই দফতর থেকে বেরোনোর সময়ে বালোটিয়া অবশ্য বলেন, সিবিআইকে লেখা সুদীপ্ত-র চিঠি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE