Advertisement
E-Paper

ভাগ-যোগ-আতঙ্ক: তৃণমূলের সংখ্যালঘু গড়ে সিঁদ কাটতে পদ্ম তিন অঙ্ক কষছে! গণিতের সেই সূত্র মেনেই ‘পিছু হটা’ শুভেন্দুর

তৃণমূলের বক্তব্য, শুধুমাত্র হিন্দুত্বে ভর করে জেতা যাবে না বুঝে শুভেন্দু সুর বদলাচ্ছেন। শাসকদলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘শুভেন্দু ব্যাক গিয়ার দিচ্ছেন।’’ কিন্তু রাজ্য বিজেপির একাংশের বক্তব্য, শুভেন্দুর নয়া ভাষ্যে তিনটি অঙ্কে তৃণমূলের চিন্তিত হওয়ার কারণ রয়েছে।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১১:৩০

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

একদা তিনি হিসাব কষে বলেছিলেন, বিজেপির বঙ্গবিজয়ের জন্য সংখ্যালঘু ভোট পাওয়া জরুরি নয়। বলেছিলেন, সংখ্যালঘুরা বিজেপি-কে ভোট দেন না। সংখ্যালঘুদের ভোট তাঁর দরকারও নেই! কত শতাংশ হিন্দু ভোটার বিজেপিতে একজোট, সে হিসাবও তিনি একের পর এক জনসভায় তুলে ধরেছিলেন। দাবি করছিলেন, মাত্র ৫-৬ শতাংশ হিন্দু ভোট বাড়লেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়বে। কিন্তু রাজ্যে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) ঘোষিত হওয়ার দু’দিন আগে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সেই বয়ান বদলে গিয়েছে। তিনি বলে বসেছেন, ‘‘সংখ্যালঘু ভোট চাই না বলিনি। বলেছি, সংখ্যালঘু ভোট আমরা পাই না।’’

আচমকা এই সুরবদল আপাতদৃষ্টিতে পিছু হটারই ইঙ্গিতবাহী। আবার অনেকের মতে, তা নয়। এ আসলে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার কৌশল।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পর্কে রেখেঢেকে মন্তব্য করার কোনও সিদ্ধান্ত বঙ্গ বিজেপি নিয়েছে বলে খবর নেই। বাংলায় মেরুকরণের আবহ কমানোর জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্দেশ দিয়েছেন বলেও কারও জানা নেই। বরং পশ্চিমবঙ্গের মফস্সল ও গ্রামাঞ্চলে বিজেপির ফলাফল অপেক্ষাকৃত ভাল হওয়ার নেপথ্যে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের আবহই, তা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারাও জানেন। তা হলে শুভেন্দুর উলটপুরাণের কারণ কী?

তৃণমূলের বক্তব্য, শুধুমাত্র হিন্দুত্বে ভর করে জেতা যাবে না বুঝে শুভেন্দু সুর বদলাচ্ছেন। শাসকদলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘শুভেন্দু ব্যাক গিয়ার দিচ্ছেন।’’ কিন্তু রাজ্য বিজেপির একাংশের বক্তব্য, শুভেন্দুর নয়া ভাষ্যে তিনটি অঙ্কে তৃণমূলের চিন্তিত হওয়ার কারণ রয়েছে।

১. ভাগের অঙ্ক

রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের বিপদ— এমন ধারণা যত দিন বদ্ধমূল থাকবে, তত দিন সব অসন্তোষ ভুলে সংখ্যালঘুরা জোড়াফুলেই ছাপ দেবেন। তাই শুভেন্দুরা সেই ধারণাকে দুর্বল করে সংখ্যালঘু ভোট ভাগের রাস্তা খুলতে চাইছেন। শুভেন্দু বোঝাতে চেয়েছেন, বিজেপি সংখ্যালঘুদের অপছন্দ করে না ঠিকই। কিন্তু সংখ্যালঘু ভোট না পাওয়ার ‘আক্ষেপ’ও বিজেপির রয়েছে। এই নতুন ভাষ্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে সংখ্যালঘু সমাজে বিজেপি-বিদ্বেষ কমতে পারে বলে পদ্মশিবিরের আশা। বিদ্বেষ কমলে মেরুকরণের আবহ ফিকে হবে। সে ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ভোট বিজেপি না পেলেও সেই ভোট তৃণমূলের পক্ষে এককাট্টা হওয়ার প্রবণতা ধাক্কা খেতে পারে। তাতে ভোট ভাগ হতে পারে। এই ব্যাখ্যার সমর্থনে শুভেন্দুর কিছু সাম্প্রতিক মন্তব্য উল্লেখ্য। কোথাও তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম বা নওশাদ সিদ্দিকির আইএসএফ সংখ্যালঘুদের ভোট পাবে। কোথাও বলেছেন, মালদহ জেলায় তৃণমূল এ বার একটিও আসন পাবে না। ১৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি কমপক্ষে ছ’টি পাবে। বাকি আসনগুলি অন্য কোনও দল পাবে বলে শুভেন্দুর ইঙ্গিত।

২. যোগের অঙ্ক

দলে অপেক্ষাকৃত ‘উদারপন্থী’ মুখ হিসাবে পরিচিত শমীক ভট্টাচার্যকে রাজ্য সভাপতি পদে বেছে নেওয়ার সময়ে বিজেপির তরফে একটি ভাষ্য এসেছিল। তা হল, কলকাতা, শহরতলি বা দুর্গাপুরের মতো শহুরে এলাকায় যে উচ্চশিক্ষিত, সুসংস্কৃত মধ্যবিত্ত বাঙালির বাস, তাঁদের কাছে টানতে শমীকের মুখ ব্যবহার করা হবে। বিজেপি নেতৃত্বের মতে, এই জনগোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত উদার। কট্টরতায় অবিচল থেকে এঁদের কাছে টানা কঠিন। সে কথা মাথায় রেখেই শুভেন্দুও সুর বদলেছেন বলে অনেকের ব্যাখ্যা। অনেকের আশা, সংখ্যালঘুদের বিজেপি দূরে ঠেলতে চায় না। বরং কেন্দ্রের দেওয়া সব সুযোগসুবিধা সমান ভাবে পাওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘুরা বিজেপির প্রতি ‘অবিচার’ করছেন, এই অনুযোগ শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ‘বিজেপি-বিমুখতা’ কমাতে পারে। তেমন হলে আরও কয়েক শতাংশ হিন্দু ভোট পদ্মের খাতায় যোগ হতে পারে।

শুভেন্দুর মন্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার যা বলছেন, তাতেও ‘যোগের অঙ্ক’ স্পষ্ট। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বরাবরই বলেন, সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস, সব কা প্রয়াস। এটা যে কথার কথা নয়, তা সরকারি প্রকল্পগুলির উপভোক্তা তালিকা দেখলেই বুঝতে পারবেন।’’ মন্ত্রীর বক্তব্যের নিহিত অর্থ, বাড়ি হোক বা শৌচালয়, গ্রামীণ সড়ক হোক বা নলবাহিত জল, কোনও প্রকল্পের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রেই ধর্মীয় পরিচয় দেখা হয় না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘জনসংখ্যা এবং সুবিধাপ্রাপকের অনুপাত দেখলে বোঝা যাবে, সংখ্যালঘু সমাজে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার হার বেশি। বিশেষত, রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রে।’’

৩. ‘আতঙ্ক’ অঙ্ক

শুভেন্দু, শমীক, সুকান্তেরা বার বারই বলছেন, ‘‘এসআইআর নিয়ে ভারতীয় মুসলমানদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।’’ কিন্তু তাঁরা নিজেরাও জানেন, আতঙ্ক পুরোপুরি কাটছে না। তাই ভেবেচিন্তেই ‘সন্ধি’র বার্তা দিচ্ছেন বলে বিজেপির একাংশের ব্যাখ্যা। কৌশল হল এটা বোঝানো যে, বিজেপির পাশে সংখ্যালঘুরা থাকলে বিজেপি-ও ‘সঙ্কটকালে’ ত্রাতার ভূমিকায় থাকবে।

প্রত্যাশিত ভাবেই বিজেপি নেতারা কেউ প্রকাশ্যে এমন ‘অঙ্ক’ কষার কথা মানতে চাইছেন না। তবে একান্ত এবং ঘরোয়া আলোচনায় যে ধরনের ব্যাখ্যা উঠে আসছে, তাতে অঙ্কের তত্ত্বই জোরালো হচ্ছে। সে অঙ্ক ভোটের খাতায় মিলবে কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য থাকছেই।

BJP Bengal West Bengal Politics Vote Bank AITC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy