দিন পনেরো আগে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক চলচ্চিত্র প্রযোজকের দফতরে বাণিজ্য কর ফাঁকি ধরতে অভিযান চলাকালীন আচমকা ফোন নবান্নের উঁচুতলা থেকে বন্ধ করো অভিযান। তার পর থেকে হাত গুটিয়ে বসেই থাকতে হচ্ছে সমস্ত অফিসারকে। কারণ ওপরতলার নির্দেশ, আর কোনও অভিযান নয়। তার আগেও অভিযানে গিয়ে বেশ কয়েক বার আক্রান্ত হয়েছেন অফিসারেরা, হেনস্থা হয়েছেন। অভিযোগ, পুলিশকে জানানোর পরেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
আর এই সব নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন রাজ্য সরকারের বাণিজ্য কর বিভাগের অফিসারদের একাংশ। যাঁরা সকলেই ডব্লিউবিসিএস পাশ করে চাকরি করছেন।
ক্ষোভ এতটাই যে বুধবার দুপুরে বেলেঘাটা-সহ রাজ্যের অন্যত্র বাণিজ্য কর বিভাগের দফতরে জমায়েত হয়ে সেই ক্ষোভ উগরে দিলেন তাঁরা। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বিভাগের সব অফিস থেকে অফিসারেরা জড়ো হবেন বেলেঘাটার বাণিজ্য কর দফতরে। সেখান থেকে প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল বেরোবে। কিন্তু সে খবর পেয়ে মঙ্গলবার থেকেই সতর্কবার্তা দিতে শুরু করে বিভিন্ন মহল। বলা হয়, এ ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করে ক্ষোভ প্রকাশ করলে নবান্নের কোপে পড়তে হতে পারে। সরকারের এই সব কাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলায় সপ্তাহ তিনেক আগে কল্লোল সোম নামে এক কর-কর্তাকে কলকাতা থেকে বালুরঘাটে বদলি করা হয়। সেখানে কাজে যোগ দেওয়া মাত্র কল্লোলবাবুকে সাসপেন্ড করে বালুরঘাটের বাইরে না-যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে ক্ষোভের মাত্রা এতটাই যে হুঁশিয়ারি বা কল্লোল সোমের উদাহরণ দিয়েও নিরস্ত করা যায়নি বাণিজ্য-কর অফিসারদের। এ দিন দুপুরে অফিসের মধ্যেই জড়ো হয়ে তাঁরা স্লোগান দিয়েছেন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। এই দাবি মানা না হলে পুজোর পরে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার কথাও ভাবছেন তাঁরা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুচর এক চলচ্চিত্র প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতার সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর মধ্য কলকাতার অফিসে ১০ সেপ্টেম্বর হানা দিয়েছিলেন অফিসারেরা। রাজ্যের আরও পাঁচ সিনেমা প্রযোজকের দফতরেও সে দিন অভিযান চালানো হয়। অভিযোগ ছিল, কপিরাইট বিক্রি করার পরেও ঠিক মতো বাণিজ্য কর দিচ্ছে না এই সংস্থাগুলি। অন্য জায়গায় সমস্যা না হলেও ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এ অভিযান চলাকালীন ফোন আসে নবান্নের শীর্ষ মহল থেকে। ওপরতলার নির্দেশে তখনই তল্লাশি বন্ধ করে, বাজেয়াপ্ত করা নথিপত্র ভেঙ্কটেশের কর্মীদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চলে আসতে হয়েছিল অফিসারদের। আর তার দু’দিন পর থেকেই কার্যত সমস্ত অভিযান বন্ধ করে বসে যেতে হয়েছে বাণিজ্য কর দফতরকে। কারণ সে রকমই মৌখিক নির্দেশ এসেছে ওপরতলা থেকে।
অফিসারদের অভিযোগ, যে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য কর ফাঁকি দেন, তাঁদের দফতরে অভিযান চালিয়ে অর্থ দফতরের এই তদন্ত ব্যুরো ফি বছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আদায় করে দেয়। চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসে ১০০ কোটি টাকাও তোলা যায়নি। ক্ষুব্ধ অফিসারদের বক্তব্য, “সরকার তো বলে টাকার অভাব! আমরা বেআইনি ব্যবসায়ীদের জরিমানা করছিলাম। এখন তাঁদের রক্ষাকর্তা হয়ে অবতীর্ণ করছে খোদ সরকারই।”
প্রশ্ন উঠেছে, কেন আচমকা অভিযান বন্ধ করে দেওয়া হল? নির্দিষ্ট ওই প্রযোজনা সংস্থায় তল্লাশির পরের দিন থেকেই বা কেন বন্ধ হয়ে গেল এই হানা?
বাণিজ্য করের কমিশনার বিনোদ কুমার ফোন ধরেননি। এসএমএস-এর উত্তরও দেননি। জানা গিয়েছে, ১০ সেপ্টেম্বর কমিশনার দিল্লিতে ছিলেন। কলকাতায় ফিরে তিনিই অ্যাডিশনাল কমিশনারদের ডেকে পাঠিয়ে অভিযান বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
দফতর সূত্রের খবর, গত বাজেট বক্তৃতায় রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র নিজে অভিযোগ তুলেছিলেন যে এই দফতরের অফিসারেরা অভিযান চালানোর নামে হয়রান করছেন ব্যবসায়ীদের। বলা হয়েছিল, এ বার থেকে অভিযান চালানোর জন্য উচ্চপদস্থ অফিসারদের লিখিত নির্দেশ লাগবে। যদিও নতুন এই নিয়ম চালু করে সরকারি কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি। তা সত্ত্বেও দফতরের অফিসারেরা এখন উচ্চপদস্থদের লিখিত অনুমতি নিয়েই অভিযানে যান। সে দিনও বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থায় হানা দেওয়ার সময়ে সেই অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও অভিযান বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফিরে আসতে হয়েছে অফিসারদের।
অফিসারেরা জানাচ্ছেন, এই প্রথম নয়। গত বছর কর ফাঁকির অভিযোগ পেয়ে তল্লাশি চালানো হয় লালবাজারের উল্টো দিকে কম্পিউটার প্রস্তুতকারী একটি সংস্থায়। এই সংস্থার কর্তাও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। সিঙ্গাপুর সফরেও তিনি সরকারি প্রতিনিধি দলে ছিলেন। সেই অভিযানে থাকা এক অফিসারের কথায়, “সে বারও ওপরতলার ফোন পেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে তল্লাশি বন্ধ করে ফিরে আসতে হয়েছিল।”
অর্থ দফতর সূত্রের খবর, গত বছরের মার্চ মাসে ভবানীপুরের একটি রেস্তোরাঁয় তল্লাশি চালানো হয়। কয়েক কোটি টাকা কর ফাঁকিও ধরা পড়ে। ঠিক তার পরেই সরকারের শীর্ষ মহল ‘হাত গুটিয়ে নেওয়ার’ নির্দেশ দেয়। অফিসারেরা জানতে পারেন, ওই রেস্তোরাঁ মালিকও নবান্নের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। তাই অভিযানের পরেও কোনও কর আদায় হয়নি। কর কর্তারা জানাচ্ছেন, কয়েক মাস আগেই সরষের তেল এবং মদের কোম্পানির এক মালিকের দফতরে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সে বারও সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে চাপ আসায় সেই অভিযানে ছেদ পড়েছিল।
কর ফাঁকি রোধে অভিযান কেন বন্ধ করা হল, তার কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাছ থেকেও। এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে বার বার টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলেননি। ১০ সেপ্টেম্বর যে চলচ্চিত্র প্রযোজকের সংস্থায় তল্লাশি চালানোর সময় অফিসারদের ফিরে আসতে হয়েছিল, সেই শ্রীকান্ত মোহতাও চুপ। এক বার বলেছিলেন, “মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি।” তার পরে তিনি আর ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy