Advertisement
E-Paper

দুঃস্বপ্নের যাত্রা শেষ হল কাশ্মীর থেকে কফিনে

সন্ধ্যা ৭টা ২৯ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে দু’টি দেহ কাশ্মীর থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতায় পৌঁছয়। পাঁচ নম্বর কার্গো গেটের সামনে সেই কারণে বিকেল থেকেই নানা বন্দোবস্ত রাখা হয়েছিল।

সমীর গুহের কফিনবন্দি দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী শর্বরী গুহ। পাশে শোকস্তব্ধ মেয়ে শুভাঙ্গী।

সমীর গুহের কফিনবন্দি দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী শর্বরী গুহ। পাশে শোকস্তব্ধ মেয়ে শুভাঙ্গী। বুধবার, বেহালার শখেরবাজারে বাড়ির কাছে একটি ক্লাবে এনে রাখা হয় দেহ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

নীলোৎপল বিশ্বাস, মিলন হালদার

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:৩৯
Share
Save

সাড়ে তিন বছরের ছেলেটি বুঝেই উঠতে পারছে না, তার চার পাশে কী ঘটে চলেছে। সে শুধু জানে, সামনে শোয়ানো কফিনের মধ্যে যে মানুষটার নিথর দেহ রয়েছে, তিনি তার বাবা। মঙ্গলবার সারা সন্ধ্যা, বিমানে কলকাতায় নামার পর থেকে শুধু এটুকুই বলেছে সে। তাকে কে কোলে রাখবে, তা নিয়ে এর মধ্যেই এক দফা কাড়াকাড়ি হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মধ্যে। তাঁরাও জানাচ্ছেন, সাড়ে তিন বছরের হৃদান শুধু বলেছে, ‘‘ওই যে বাবা শুয়ে আছে। বলেছিল, এ বার এসে আমাদের নিয়ে যাবে। কিন্তু বাবা কই? আর কে নিয়ে যাবে?’’ একই রকম স্বগতোক্তি হৃদানের মা সোহিনী অধিকারীর গলায়। বললেন, ‘‘পারিবারিক গন্ডগোল চলছিল। নিজেদের কিছুটা সময় দিতে কাশ্মীরে গিয়েছিলাম। সেই কাশ্মীর আমাদের সমস্ত সময় কেড়ে নিল। চাইলেও আর একসঙ্গে থাকা হবে না।’’

কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় নিহত সোহিনীর স্বামী, চাকরি সূত্রে আমেরিকা নিবাসী বিতান অধিকারীর সঙ্গেই এ দিন কলকাতায় এসে পৌঁছেছে কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের কর্মী সমীর গুহর মৃতদেহ। সন্ধ্যা ৭টা ২৯ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে দু’টি দেহ কাশ্মীর থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতায় পৌঁছয়। পাঁচ নম্বর কার্গো গেটের সামনে সেই কারণে বিকেল থেকেই নানা বন্দোবস্ত রাখা হয়েছিল। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে এক রকম মুড়ে ফেলা হয়েছিল জায়গাটি। অনেকেই এসেছিলেন মৃতদের একটি বার দেখার জন্য। গার্ডরেলে ঘিরে দিয়ে তাঁদের জন্য দাঁড়ানোর জায়গা করা হয়েছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ সেখানে পৌঁছন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং একাধিক তৃণমূল পুরপ্রতিনিধি। ছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিমও। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ বিমানের চাকা কলকাতার মাটি ছুঁতেই তৎপরতা শুরু হয় ওই কার্গো গেটের সামনে। সন্ধ্যা ৮টা ৬ মিনিট নাগাদ বিমানবন্দর থেকে প্রথমে বেরোয় সমীরের মৃতদেহ। সেই গাড়িতে তাঁর পরিবারের লোকজন ছিলেন।

রাত ৯টা ১০ মিনিটে সমীরের দেহ পৌঁছয় তাঁর বেহালার বাড়িতে। তিনি স্থানীয় একটি ক্লাবের সদস্য ছিলেন। সেই ক্লাবের পুজো মণ্ডপে সমীরকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ক্লাবের সদস্য এবং স্থানীয় বাসিন্দারা ভিড় করেন সেখানে। পৌঁছন তৃণমূলের মালা রায়, বিজেপির ইন্দ্রনীল খাঁ। অনেকেই নিয়ে আসেন সাদা ফুল-মালা। ক্লাবের এক সদস্য বাবু চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘নানা অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। গত বছরও চাঁদা তুলতে গিয়েছিলেন।’’ সমীরদের এক প্রতিবেশী শম্পা মিত্র বললেন, ‘‘খুব ভাল পরিবার। পাড়ার লোকের বিপদে সব সময়ে পাশে পেতাম ওঁকে।’’ বাড়িতে দেহ পৌঁছনোর পরে সমীরকে শ্রদ্ধা জানান তাঁর অফিসের সহকর্মীরা। এক সহকর্মী রজত সেন বলেন, ‘‘দাদা খুবই ভদ্র, নম্র ছিলেন। যে কোনও সমস্যা, সে বাড়িতেই হোক বা কর্মক্ষেত্র, সব সময়ে দাদাকে পাশে পেতাম।’’ এ দিন বাবার মরদেহের সামনে কার্যত পাথর হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় সমীরের মেয়ে শুভাঙ্গীকে। কাঁদতেও যেন ভুলে গিয়েছে সদ্য দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়া ওই কিশোরী। রাত ৯টা ৪২ মিনিটে সমীরের দেহ নিয়ে শববাহী গাড়ি রওনা দেয় কেওড়াতলা শ্মশানের উদ্দেশে। রাত ১০টা নাগাদ কেওড়াতলা শ্মশানে পৌঁছয় তাঁর দেহ। তার আধ ঘণ্টা পরে পৌঁছয় বিতানের মৃতদেহ। তার আগে একই চিত্র দেখা যায় বৈষ্ণবঘাটা লেনে বিতানের বাড়ি রূপকথা আবাসনের সামনে। সেখানে ৯টা ৫ মিনিটে পৌঁছয় বিতানের মৃতদেহ। কফিনবন্দি দেহটি এর পরে আবাসনের দোতলার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিতানের বয়স্ক বাবা-মা। তিরিশ মিনিট সেখানে শায়িত থাকে বিতানের মরদেহ। এর পরে কফিনবন্দি বিতানের দেহ নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশে রওনা দেয় শববাহী গাড়ি। কিন্তু বিতানের স্ত্রী আর শ্মশানে যাননি। এ দিন শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পরে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বিতান ও সমীরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

তার আগে মৃতদেহ নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে এক বার শেষ দেখা দেখতে ফ্ল্যাটের বারান্দার দিকে পা বাড়ান বিতানের স্ত্রী। কিন্তু মুহূর্তে ফিরে আসেন বারান্দায় গ্রিলের কাছে রাখা খাঁচাবন্দি দু’টি ককটেল প্রজাতির পাখি দেখে। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘পাখি দুটো ছেলেকে কিনে দিতে বলেছিলে। পাখি দুটো রয়ে গেল, তুমি আর নেই।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

TRF Kashmir Terror Attack

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy