প্রবল হাঁকডাক পাড়ার মোড়ের কলের কাছে। বালতি, গামলা পেতে লম্বা লাইন। কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পরে ভিড় ঠেলে কলের কাছে পৌঁছে চেঁচাতে শুরু করলেন এক ব্যক্তি। বললেন, ‘‘আজও সরু হয়ে জল পড়ছে! এ ভাবে হবে না। রোদে খটখটে কলপাড়টাও ভেজেনি। হ্যান্ড-পাম্পই লাগবে।’’ কথা শেষ হতে না হতেই কয়েক জন ছুটলেন বাড়ির দিকে। আনা হল, মাটি থেকে এক হাত উচ্চতার পুরনো নলকূপ সদৃশ যন্ত্র। সেটির পাইপ কলের মুখে লাগিয়ে পাম্প করে শুরু হল জল বার করা। এক দল পাম্প করছেন, অন্য দল পাত্র ভরছেন!
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, গরম পড়তেই বেলেঘাটার রাসমণি বাজার এলাকার এই চিত্রই দেখা যাচ্ছে শহরের নানা জায়গায়। অভিযোগ, কোথাও জল পড়ছে এত সরু ধারায় যে, পাত্র ভরতে অনেক সময় লাগছে। নির্দিষ্ট সময় পরে জল আসা বন্ধ হলে দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় জলটুকুও মেলেনি। কোথাও আবার জলের সঙ্গে বেরোচ্ছে পোকা। বহু এলাকায় ঘোলা জল পড়াও নিত্যদিনের ব্যাপার। অবস্থা এমনই যে, পানীয় জলের সঙ্গে দৈনন্দিন অন্যান্য প্রয়োজনের জলও কিনতে হচ্ছে!
গরমে প্রতি বছর জলকষ্টের এই চিত্র সামনে এলেও প্রশাসনিক স্তর থেকে কি পাকাপাকি সমাধান করা যাচ্ছে না? অনেকেই জানাচ্ছেন, ২০২০ সালে কলকাতা পুরসভা জলস্তরের নিরিখে শহরের রং-ভিত্তিক, অর্থাৎ ‘কালার কোডেড জ়োনাল ম্যাপ’ প্রকাশ করার কথা ঘোষণা করেছিল। যেখানে লাল, কমলা ও সবুজ— এই তিনটি রঙের মাধ্যমে জলস্তরের পরিস্থিতি নির্দিষ্ট করার কথা বলা হয়। ঠিক হয়, যেখানে জলস্তর বিপজ্জনক ভাবে নেমে গিয়েছে, সেই এলাকা চিহ্নিত হবে লাল রঙে। কমলা রং বোঝাবে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলস্তর দ্রুত নামছে, যা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। আর সবুজ রং বোঝাবে, ওই এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর ঠিক রয়েছে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে অবিলম্বে জলের কষ্টের নিরিখে বিপজ্জনক, ক্রমশ বিপজ্জনক দিকে এগোচ্ছে, এমন এলাকা ধরে রং-ভিত্তিক মানচিত্র প্রকাশ করা উচিত।
পুরসভা সূত্রের খবর, প্রাপ্ত অভিযোগের নিরিখে ১০০ থেকে ১৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে জলকষ্ট সর্বাধিক বলে জানা গেলেও গত কয়েক বছরে ৯০ নম্বর ওয়ার্ডের পর থেকেই পানীয় জলের সমস্যার কথা জানাচ্ছেন বাসিন্দারা। এ বছর তার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে মধ্য, পূর্ব ও উত্তর কলকাতার একাধিক বরো। ওই সমস্ত এলাকার বস্তি-কেন্দ্রিক জ়োনে জলকষ্ট সব চেয়ে বেশি। কোথাও নলকূপের মতো পাম্প লাগিয়ে জল টেনে বার করা হচ্ছে কল থেকে, কোথাও ছোট পাম্প বসিয়ে জল টানা হচ্ছে সরাসরি পুরসভার ভূগর্ভস্থ লাইন থেকে। যাদবপুর, টালিগঞ্জে আবার জল সরবরাহের জন্য এখনও গভীর নলকূপের উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে।
কলকাতা পুর এলাকায় ২৭০টি ভূগর্ভস্থ নলকূপ রয়েছে। বেশির ভাগই যাদবপুর, টালিগঞ্জ, রানিকুঠি, গরফা, বাঁশদ্রোণীতে। কসবা, মুকুন্দপুর, আনন্দপুরের একাংশও এখনও ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের উপরে নির্ভরশীল। পিকনিক গার্ডেন, বেহালা ও জোকার কিছু এলাকাতেও পরিস্রুত জল পৌঁছয়নি। ১১১ নম্বর ওয়ার্ডের আতাবাগান, ব্রহ্মপুর, প্রগতি পার্ক, নাথপাড়া, গীতাঞ্জলি পার্ক, শান্তি সরণি, রবীন্দ্রপল্লির মতো এলাকাতেও জলকষ্ট চলছে। ৯২ নম্বর ওয়ার্ডে এমন পরিস্থিতি বাবুবাগান, এ পি চ্যাটার্জি রোড, নিউল্যান্ড ঝিল রোড এবং ৯৫ নম্বর ওয়ার্ডের অরবিন্দনগর, আজাদগড়-সহ বিভিন্ন এলাকায়। ১১ নম্বর বরোর ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের পার্ক টেরাস, সাউথ পার্ক, সাউথ রোড, অ্যাভিনিউ সাউথ, শান্তিপথ, মডার্ন পার্ক থেকে শুরু করে ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডের কালিকাপুর, ইস্টার্ন পার্ক, ব্যাঙ্ক প্লট, সুইটল্যান্ডের মতো এলাকায় এপ্রিল থেকেই জলসঙ্কট চলছে। ১০৬ থেকে ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডেও জলকষ্ট চলছে।
পুরকর্তাদের দাবি, পরিস্থিতি সামাল দিতে শহরে পাঁচটি জল প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘জলের উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সমস্যা যা আছে, আগামী গ্রীষ্মের আগেই মিটে যাবে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)