Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘রেডি! এ বার গুলি চালাতে পারেন’

পুলিশ কর্তাদের কথায়, ‘‘এ রাজ্য এখন অস্ত্রের ভাণ্ডার। যা উদ্ধার হয়েছে তা অতি সামান্য। সঠিক লোক ধরতে পারলে হাতে অস্ত্র আসতে অসুবিধা হবে না।’’

বেআইনি: পাওয়া যাচ্ছে মুঙ্গেরে তৈরি এই আগ্নেয়াস্ত্র। নিজস্ব চিত্র

বেআইনি: পাওয়া যাচ্ছে মুঙ্গেরে তৈরি এই আগ্নেয়াস্ত্র। নিজস্ব চিত্র

শুভাশিস ঘটক
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ০০:২৪
Share: Save:

মোটরবাইকের পিছনে বসে বানতলা থেকে ঘটকপুকুরের দিকে বেশ কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরে ডান দিকের একটি সরু রাস্তায় ঢুকে পড়লেন বাইকচালক। ঘিঞ্জি না হলেও ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা। রাস্তার পাশে দোকান, একতলা-দোতলা বাড়িও রয়েছে। ভেড়ি এলাকা হওয়ায় মাছ ধরার জালও শুকোতে দেখা গেল। কিছু দূর গিয়ে একটি দোতলা বাড়ির সামনে বাইক থামালেন চালক। বাড়ির একতলায় ‘ফ্লেক্স-প্রিটিং’ চলছে। বাড়ির দোতলায় নাকি চলে অন্য ব্যবসা। খবর ছিল, ফ্লেক্স-প্রিন্টিং ব্যবসার আড়ালে চলে আগ্নেয়াস্ত্রের কারবার।

সাংবাদিকতার পেশার সুবাদে পরিচিত বেআইনি অস্ত্রের এক ক্রেতার বাইকে চেপেই পৌঁছে যাওয়া গেল দক্ষিণ ২৪ পরগনার সেই প্রত্যন্ত এলাকায়। গোয়েন্দাদের পরামর্শ ছিল, অস্ত্র কারবারিদের সন্দেহ এড়াতে বেআইনি অস্ত্রের ডেরায় তাঁদের পরিচিতদের সঙ্গে যাওয়াই ভাল। একইসঙ্গে গোয়েন্দারাই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কারবারিদের সঙ্গে দরদাম না করে তাঁদের দামেই অস্ত্র কিনতে। অতএব দোতলায় সেই অস্ত্রের গুদামে সহজেই ঢুকে পড়া গিয়েছিল। অস্ত্র কারবারিও নির্দ্বিধায় একের পর এক আগ্নেয়াস্ত্রের নমুনা দেখাতে লাগলেন।

স্বচ্ছ কাচের টেবিলে রাখা ল্যাপটপ। উল্টো দিকে বসা সুদর্শন যুবক সঙ্গী ক্রেতাকে কারবারি যুবক বলে উঠলেন, ‘‘তোমার ক’টা লাগবে? নাইন (পড়ুন নাইন এমএম) না সেভেন (পড়ুন সেভেন এমএম)।’’ ক্রেতার উত্তর, ‘‘রিভলভার। যেটা নতুন এসেছে।’’ একটি রিভলভার নিজের হাতে সামান্য নাড়াচাড়া করে টেবিলের উল্টোদিকে পাঠিয়ে দিলেন কারবারি। তার পরে ক্রেতাকে বললেন, ‘‘এটা দেখ ভাল করে। মুঙ্গেরের জিনিস। পুলিশের রিভলভারের সঙ্গে পাল্লা দেবে। এর নাম সটান।’’ অতি সাধারণ একটি বাড়ির দোতলার খুপরি ঘরে না এসে বসলে বোঝা যেত না যে এটি দেশি ও অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের কার্যত সংগ্রহশালা।

ভোটের বাজারে শহর ও শহরতলিতে অস্ত্র কারখানার হদিস পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গ্রেফতার হয়েছেন কারবারিরা। উদ্ধার হয়েছে অস্ত্রও। পুলিশ কর্তাদের কথায়, ‘‘এ রাজ্য এখন অস্ত্রের ভাণ্ডার। যা উদ্ধার হয়েছে তা অতি সামান্য। সঠিক লোক ধরতে পারলে হাতে অস্ত্র আসতে অসুবিধা হবে না।’’

সঙ্গে থাকা অস্ত্রের ক্রেতাটির সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। কারবার কী ভাবে চলে তা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করায় প্রথমে সেই ডেরায় নিয়ে যেতে নিমরাজিই ছিলেন ওই ক্রেতা।

অনেক কষ্টে তাঁকে রাজি করাতে হয়েছিল। তাঁর কথামতো বাসন্তী হাইওয়েতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দোতলায় ওঠার পথে চোখে পড়েছিল বাড়ির একতলায় কয়েক জন তরুণ-তরুণী প্রিন্টিংয়ের কাজ করছেন। জানা গেল, তাঁরা কমিশনের বিনিময়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের

কাজ করেন।

কথাবার্তা চলাকালীন টেবিলের নীচ থেকে সটান নামের কালো চকচকে সেই রিভলভার বার করে এ পাশে ঠেলে দিল ওই যুবক। জানালেন, দাম ২২ হাজার। সঙ্গে বিনামূল্যে ছ’টা গুলি। বাড়তি গুলির প্রতিটির দাম চারশো টাকা। গত ছ’মাসে নাকি কয়েক লক্ষ টাকার কারবার হয়েছে ওই রিভলভার থেকে। রিভলভারটি নিয়ে ডানদিকে হাল্কা চাপ দিতেই বেরিয়ে এল চেম্বার। পরপর ছ’টি গুলি ভরার জায়গা। রিভলভার লোর্ড হতেই সেই যুবক অস্ত্র ব্যবসায়ী বলে উঠলেন, ‘‘নাউ ইউ আর রেডি টু শুট’। এ বার গুলি চালাতে পারেন।’’ এর পরেই বন্ধু ক্রেতা সেটি পকেটে ঢুকিয়ে

উঠে পড়লেন।

ফেরার পথে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, ‘‘কলকাতার এত কাছে অস্ত্রের কারবার চলছে পুলিশ টের পায়নি?’’ সঙ্গী অস্ত্র-ক্রেতার জবাব, ‘‘এটা কলকাতা ও বারুইপুর জেলা পুলিশের সীমান্ত এলাকা। কলকাতা পুলিশ ভাবে, এটা জেলার এলাকা। আর জেলা পুলিশ ভাবে, এটা কলকাতা পুলিশের। তাই কারও তেমন নজরদারি নেই।’’ সঙ্গীর আরও উত্তর, ‘‘ওই কারবারি মুঙ্গের থেকে পিস্তল, রিভলবার, কার্তুজ নিয়ে আসেন। আবার বাইপাস সংলগ্ন এলাকার কারখানা থেকেও আমদানি করে।’’

এ রাজ্য যে দিন দিন অস্ত্র-ভাণ্ডার হয়ে উঠছে তা মানছেন বিরোধী নেতারাও। কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানের কথায়, ‘‘গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই বোঝা গিয়েছে যে এ রাজ্য অস্ত্র-ভাণ্ডার। শাসক দলের একাংশের মদতে এই ব্যবসা ছড়িয়েছে। রাজনৈতিক চাপে অস্ত্র কারবারিদের ধরতে সাহস পায় না পুলিশ।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘কয়লা, গরু পাচারকারীর মতো অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও রাজ্যের শাসক দলের ছত্রছায়ায় রয়েছে। তাই এ রাজ্য অস্ত্র কারবারেও এক নম্বরে।’’ সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্যে সবই এখন লাগাম ছাড়া। ফলে অস্ত্র কারবারিরা ঘাঁটি তৈরি করবে এ নতুন কী! শাসক দলের নেতা ও পুলিশ সবই জানেন।’’

শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিরোধীদের সব বিষয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। এ রাজ্য এখন তো নির্বাচন কমিশনের অধীনে। কমিশন তদন্ত করে অস্ত্র উদ্ধার করুক। ব্যবসায় কারা জড়িত স্পষ্ট হয়ে যাবে।’’

রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘মুঙ্গেরের যে রিভলভার আমরা উদ্ধার করেছি তা পুলিশের রিভলভারের থেকে কোনও অংশে কম নয়। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে অস্ত্র কারবারীদের নানা যোগাযোগের সূত্রও মিলেছে। এ সব ঠেকাতে কয়েক বার উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। একটা ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়েছে। নির্বাচনের পরই সেই অনুযায়ী তল্লাশি শুরু হবে।’’

যাত্রা শেষে বাইপাসে সাংবাদিককে নামিয়ে উত্তর কলকাতায় নিজের ঠিকানায় রওনা দিলেন রিভলভারের সেই ক্রেতা। ঘোর যেন কাটছিল না। গরমের দুপুরে ফাঁকা বাইপাসে কানে যেন ভেসে আসছিল সেই দু’টি কথা,‘‘রেডি টু শুট’। এ বার গুলি চালাতে পারেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Munger Illegal Arms
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE