Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
বিল আটকে তাপসের

পরিষদীয় সচিব নিয়ে দোটানায় নবান্ন

হাইকোর্টের রায়ে পরিষদীয় সচিবদের পাইয়ে দেওয়ার পাট চুকলেও এখনও তাঁদের টাকা ফেরত দিতে বলেনি রাজ্য সরকার। আদৌ ওই টাকা ফেরত নেওয়া হবে কি না, প্রশাসনের শীর্ষ মহল কয়েক দফা বৈঠকের পরও চূড়ান্ত করতে পারেনি। এর মধ্যেই পরিষদীয় দফতরের পরিষদীয় সচিব তাপস রায় স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে তাঁর পাওনাগণ্ডা চেয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ায় গোল বেঁধেছে নবান্নে। এক লপ্তে ২৭ মাসের ভাতা চেয়ে প্রায় ৮ লক্ষ টাকার বিল জমা দিয়েছেন তাপসবাবু।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

হাইকোর্টের রায়ে পরিষদীয় সচিবদের পাইয়ে দেওয়ার পাট চুকলেও এখনও তাঁদের টাকা ফেরত দিতে বলেনি রাজ্য সরকার। আদৌ ওই টাকা ফেরত নেওয়া হবে কি না, প্রশাসনের শীর্ষ মহল কয়েক দফা বৈঠকের পরও চূড়ান্ত করতে পারেনি। এর মধ্যেই পরিষদীয় দফতরের পরিষদীয় সচিব তাপস রায় স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে তাঁর পাওনাগণ্ডা চেয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ায় গোল বেঁধেছে নবান্নে। এক লপ্তে ২৭ মাসের ভাতা চেয়ে প্রায় ৮ লক্ষ টাকার বিল জমা দিয়েছেন তাপসবাবু।

সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন তুলে গত ১ জুন ‘পশ্চিমবঙ্গ পরিষদীয় সচিব (নিয়োগ, বেতন, ভাতা আনুষঙ্গিক নিয়মবিধি)’ আইন বাতিল করে হাইকোর্ট। ওই আইন বলেই শাসক দলের নেতৃত্বের একাংশকে আনুগত্যের পুরস্কার দেওয়া এবং দলে অসন্তোষ ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ বিরোধীদের। এখন হাইকোর্টের রায়ের পরে প্রতিমন্ত্রীর সমতুল পরিষদীয় সচিবদের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করা হবে কি না, তা নিয়ে টানাপড়েন চলছে রাজ্য প্রশাসনে। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘কার্যত রাজনৈতিক তাগিদেই ওই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রশাসন তার আইনি রূপ দিয়েছিল মাত্র। আমরা এখন সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছার দিকেই তাকিয়ে আছি।’’

কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি নবান্নে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সর্ব্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা একাধিক সরকারি আইনজীবীর পরামর্শ নিলেও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। প্রশাসনের একাংশ বলছেন, সুপ্রিম কোর্টে গেলে ফের মুখ পুড়বে রাজ্যের। তার চেয়ে পরিষদীয় সচিব পদ তুলে অন্য কোনও পদ দিয়ে তাঁদের একই রকম সুয়োগ-সুবিধা দেওয়া হোক। অন্য অংশের বক্তব্য, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির বার্তা দিতে হাইকোর্টের রায় মেনে নিক সরকার। একই সঙ্গে বেতন-ভাতা ফিরিয়ে দিতে বলা হোক পরিষদীয় সচিবদের। কিন্তু সেই আম-ছালা দুই যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর অনুমোদন মিলবে কি না, তা নিয়েই সংশয়ে নবান্নের কর্তারা।

এর মধ্যেই তাপসবাবুর চিঠি পেয়ে দোটানায় পড়েছেন নবান্নের কর্তারা। প্রশাসনের খবর, গত মাসের ২৪ তারিখে তাপসবাবু আট লক্ষ টাকার নথি দাখিল করেন স্বরাষ্ট্র দফতরের এসটাব্লিশমেন্ট শাখায়। এই শাখাই মন্ত্রীদের বেতন, ভাতা-সহ নানা পাওনা মেটানোর দায়িত্বে। পরিষদীয় সচিব হিসেবে এ পর্যন্ত তাঁর যা পাওনাগণ্ডা হয়েছে সরকারের কাছে সেই প্রাপ্যই দাবি করেন তাপসবাবু। কিন্তু তাঁর দাখিল করা ওই নথি এসটাব্লিশমেন্ট শাখার নানা টেবিলে ঘোরাফেরার মধ্যেই গত ১ জুন পরিষদীয় সচিব নিয়োগের আইন বাতিল করে দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। আর সেখানেই জটিলতার সূত্রপাত।

নবান্নের খবর, হাইকোর্টের রায় বেরোনো মাত্রই তাপসবাবু যোগাযোগ করেন নবান্নে। সরকার যাতে তাঁর পাওনাগণ্ডা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেয়, সেই আর্জি জানান ওই পরিষদীয় সচিব। কিন্তু আদালত যখন আইনটাই বাতিল করে দিয়েছে, তখন কী ভাবে তাপসবাবুর টাকা মেটানো হবে, তা নিয়ে ধন্দে পড়ে প্রশাসন। নবান্নের একাধিক শীর্ষ কর্তাও তখন স্বরাষ্ট্র দফতরের অফিসারদের জানিয়ে দেন, হাইকোর্ট রায়ে ঠিক কী বলেছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানার আগে বকেয়া মেটানোর প্রক্রিয়া শুরু করা সমীচীন হবে না। ফলে তাপসবাবুর আবেদন সাময়িক ভাবে চাপা পড়ে যায়।

এর পরে আর তাপসবাবুর পাওনা মেটায়নি স্বরাষ্ট্র দফতর। ওই দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘প্রতি মাসে বিল পেশ করার কথা পরিষদীয় সচিবদের। তবে অনেকেই তিন-চার মাসের টাকাও এক সঙ্গে নিয়েছেন। তাপসবাবু কোনও দিনই বিল জমা দেননি।’’ এ কথা মেনে নিয়ে তাপসবাবু বলেন, ‘‘পরিষদীয় সচিব হিসেবে আমি কোনও সুবিধা নিইনি। বিলও জমা দিইনি। এই প্রথম ভাতা বাবদ ২৭ মাসের বিল জমা দিয়েছি। এটা আমার প্রাপ্য। এর পরে সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই মানব।’’ নবান্নের খবর, স্বরাষ্ট্র দফতরের
যে শাখায় তাপসবাবুর আট লক্ষ টাকার বিল আটকে রয়েছে, তারাই রাজ্যের উদ্বাস্তুমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের চশমা খরচের এক লক্ষ টাকা অনুমোদন করেছিল। প্রশাসনে এখন তা নিয়েও গুঞ্জন।

রাজ্যের বিরুদ্ধে যিনি এই মামলা লড়েছিলেন, সেই বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন তুলে আদালত পরিষদীয় সচিব নিয়োগ আইনটাই খারিজ করে দিয়েছে। ফলে ওই আইনবলে পরিষদীয় সচিবেরা যে আর্থিক সুবিধা ভোগ করেছেন তা ফেরত দেওয়াটাই নৈতিকতা।’’ কিন্তু সেই নৈতিকতা নবান্ন দেখাবে কি না, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যেই অবশ্য হাতে গোনা কয়েক জন পরিষদীয় সচিব স্বেচ্ছায় নীল বাতি লাগানো গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। তবে অফিস কেউই ছাড়েননি। তফাত একটাই, আগে যা-ও বা মাঝেমধ্যে অফিসে বসতেন পরিষদীয় সচিবেরা, এখন সেটাও লাটে উঠেছে। হাইকোর্টের রায় বোরোনোর পরে এ পর্যন্ত সরকারি পদক্ষেপ বলতে একটাই, বিধানসভায় পরিষদীয় সচিবদের জন্য যে পৃথক হাজিরা খাতা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, এই কাজের জন্য দলের মধ্যেই যথেষ্ট গঞ্জনা সইতে হয়েছে তৃণমূলের মুখ্যসচেতক শোভনদেব চট্টেপাধ্যায়কে।

কিন্তু বেতন-ভাতা ফেরানোর কী হল? নবান্নের ছোট-বড় কোনও কর্তাই এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। একাধিক পরিষদীয় সচিব বলেছেন, ‘‘আদালতে সরকার লড়েছিল। এখন সরকার যদি আমাদের বলে টাকা ফেরত দিন, আমরা দিয়ে দেব!’’
কিন্তু সেই নির্দেশিকা এখনও জারি করেনি প্রশাসন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE