সম্প্রতি আমি একটি থিয়েটার করছি। মিনার্ভা রেপার্টরি-র নতুন প্রযোজনা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের টুয়েলভথ নাইট অবলম্বনে ‘মুম্বাই নাইটস’। অর্থাৎ, গোটা শেক্সপিয়ারিয়ান প্রেক্ষাপটটাকে আমরা নিয়ে এসেছি সমসাময়িক মুম্বই শহরে, যেখানে এই মেট্রোপলিস তার নানান রং, নানান বিচ্ছুরণ, তার ক্রিকেট, আন্ডারওয়ার্ল্ড, নাইটলাইফ, বলিউড, সমাজজীবন, গণপতি-বন্দনা— এ সব কিছু মিলেমিশে একটা বর্ণবহুল ক্যালাইডোস্কোপিক চেহারা নিচ্ছে। অ্যাডাপ্টেশনটা করেছে তরুণ নাট্য পরিচালক দেবাশিস রায়। ফর্মটি একান্ত ভাবেই বলিউড সিনেমার ধাঁচার এক ধরনের বিনির্মাণ। স্বভাবতই মহারাষ্ট্রের এবং মুম্বই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানান ধর্মীয় অনুষঙ্গ, বিশেষত হিন্দু-মুসলমানের দীর্ঘ দিন সহাবস্থান এই থিয়েটারটিতে চলে আসে।
আমাদের স্থানীকরণে সেবাস্টিয়ান এবং ভায়োলা, এরা মুম্বইয়ের টুইন সিটি করাচি থেকে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে মুম্বইতে আসে এবং ২০১১-র বিখ্যাত বিস্ফোরণের মুখোমুখি হয়। যমজ দুই ভাইবোন পরস্পরের থেকে ছিটকে যায়। বোনটি ভায়োলা-র মতোই পুরুষ সেজে ওঠে অর্সিনো বা আমাদের স্থানীকরণে মুম্বইয়ের বিখ্যাত প্রযোজক আলিশান কুলকার্নির অফিসে। সেখানে সে পুরুষ সেজে চাকরি করে। নাম নেয় বিল্লু তিওয়ারি। কাজ করতে গিয়ে বিল্লু তথা হুমা প্রেমে পড়ে যায় আলিশানের। আলিশান আবার প্রেমে পড়েছে মুম্বইয়ের বিখ্যাত গ্ল্যামারকুইন ‘অলিভিয়া’ তথা উষ্ণতা কুল ওসমানি-র। উষ্ণতা আবার মুম্বইয়ের বিখ্যাত আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন ইয়াকুব চিকনা ওসমানি-র বোন। পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া ইয়াকুবকে মুম্বই বিস্ফোরণে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করেন। ফলে, উষ্ণতা ঠিক করে সে আর সিনেমা করবে না। বরং দাদার অবর্তমানে কোম্পানি চালাবে। সে আলিশানের প্রেম প্রত্যাখ্যান করে। আলিশান তখন বিল্লুরূপী হুমাকে পাঠায় উষ্ণতার কাছে তার দূত হিসেবে। উষ্ণতা আলিশানকে আবার প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু এ বার সে প্রেমে পড়ে যায় আলিশানের দূত বিল্লু তিওয়ারির।
ও দিকে, হুমার যমজ ভাই আসগর মুম্বই বিস্ফোরণের পর বান্দ্রার বিখ্যাত আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন ছোটা রাজনের ডান হাত ডি কে রাওয়ের স্যাঙাৎ ধরম কাল্লা-র কাছে আশ্রয় পায়। ধরম কাল্লা আসগরকে বোমার জখম থেকে সেবাসুশ্রূষা করে সারিয়ে তোলে। এর পর আসগর তার বোনকে খুঁজতে বেরোয়। সে দাদারে আসে। সে দাদারে ঢোকার পর কেউ কেউ বিল্লুকে আসগর ভাবে, আবার কেউ কেউ আসগরকে বিল্লু ভাবে। যাবতীয় ক্যাঁচাল শুরু হয়। শেষে রহস্যের জাল উন্মোচিত হয়, আলিশানের সঙ্গে বিয়ে হয় হুমার। আর আসগরের সঙ্গে বিয়ে হয় উষ্ণতার। একদম শেষে গিয়ে আসগর বলে, সে ‘পর্ক’ খাবে আর আলিশান বলে ‘বিফ’ খাবে।
এই ভাবে ভারত-পাকিস্তান, হিন্দু-মুসলমান সবাই আরব সাগরের তীরে একাকার হয়ে যায়। আমার মনে হয়, এই অসহিষ্ণুতার সময় আসগর-উষ্ণতা বা আলিশান-হুমার প্রেমই আমাদের বাঁচাতে পারে। কারণ, ভালবাসাই একমাত্র টোটকা, যা আমাদের যাবতীয় বর্বরোচিত, জান্তব, নিষ্ঠুর প্রবৃত্তি খসিয়ে মানবিক সুকুমার বৃত্তিগুলিকে উদ্ভাসিত করতে পারে। এই কালবর্গী হত্যা, নরেন্দ্র দাভোলকরকে হত্যা করা, ইউ আর আনন্দমূর্তি-র সঙ্গে অসভ্যতা করা এবং বাংলাদেশে ব্লগারকে খুন করা— এ সমস্ত কিছুর থেকে যদি আমাদের বেরিয়ে আসতে হয়, তা হলে একটাই রাস্তা থাকে। তা হল, অন্যের ধর্মের মৌলবাদ নিয়ে কথা বলার আগে যে যার নিজের ধর্মের মৌলবাদ নিয়ে কথা বলুক। অর্থাৎ, সেকুলার হিন্দু কথা বলুক হিন্দু মৌলবাদ নিয়ে, তার পরে রাখুক মুসলিম মৌলবাদকে। পাশাপাশি, সেকুলার মুসলিম আগে কথা বলুক মুসলিম মৌলবাদ নিয়ে, পরে কথা বলুক হিন্দু মৌলবাদ নিয়ে। এক জন প্রকৃত ভারতীয় কথা বলুক ভারতবর্ষের ভেতরে ঘটতে থাকা মৌলবাদ নিয়ে। অন্য দেশের মৌলবাদ নিয়ে আলোচনা সরিয়ে রেখে। কারণ, অন্য দেশ যদি মৌলবাদী হয় তাতে ভারতবর্ষের কী? তা হলেই আমাদের দেশে এই অসহিষ্ণুতাকে অন্তত আমরা দূরে সরিয়ে রাখতে পারব। এই ‘মুম্বাই নাইটস’ তখন ঝলমল করে উঠবে সমস্ত ভারতবর্ষে। মৌলবাদের দাপট যখন ভয়াল চেহারা নিচ্ছে তাকে সরিয়ে রেখে ভারতবর্ষের প্রকৃত আত্মাটি আবার জয়যুক্ত হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy