Advertisement
E-Paper

‘শুধু জানি ও হল এ দেশের মেয়ে, ভারতের মেয়ে’

সাজদা বলছিলেন, ‘‘যখন চিকিৎসক মেয়েকে দেখালেন, সে সময়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। যাঁরা মা হয়েছেন, তাঁরাই এই অনুভূতিটা বোঝেন।’’

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:১৭
নবজাতক: সাজদা-জিশানের সঙ্গে সদ্যোজাত। নিজস্ব চিত্র

নবজাতক: সাজদা-জিশানের সঙ্গে সদ্যোজাত। নিজস্ব চিত্র

২৪ ডিসেম্বর যখন সাজদা নাসেরকে এসে চিকিৎসক বলেছিলেন, ‘‘এই দেখো, তোমার মেয়ে। খুশি তো?’’, তখন পোশাক দেখে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে দেশ উত্তাল। সে দিনই জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিতর্কের মধ্যেই জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর) পরিমার্জন খাতে ৩৯৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। সে দিনই আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মঞ্চে নাগরিকত্ব আইনের প্রতিলিপি ছিঁড়ে প্রতিবাদ করেছিলেন এক ছাত্রী।

কিন্তু উত্তাল এই সময় সাজদা নাসেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। সাজদা বলছিলেন, ‘‘যখন চিকিৎসক মেয়েকে দেখালেন, সে সময়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। যাঁরা মা হয়েছেন, তাঁরাই এই অনুভূতিটা বোঝেন।’’ কিন্তু ‘নতুন ভারত’, যেখানে পোশাক-ধর্ম দেখে মানুষ কেমন তা চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেখানে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হচ্ছে না? মেয়ের বয়স মাত্র আট দিন। এর মধ্যেই সাজদার দৈনন্দিন রুটিনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। মেয়েকে নিয়ে সারা ক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাঁকে। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই সাজদা স্পষ্ট বললেন, ‘‘কেন চিন্তা হবে? এখন যা হচ্ছে সব সাময়িক। এটা চলতে পারে না। দেশের ভিত এত আলগা নয় যে রাতারাতি পাল্টে যাবে।’’ সাজদাকে সমর্থন করলেন তাঁর স্বামী জিশান আহমেদ। জিশানের কথায়, ‘‘হঠাৎ করেই একদল লোক বিভাজন তৈরির চেষ্টা করল, সেটা তো হতে পারে না। আমরা সবাই সমান। মনে হয় না আমাদের মেয়েকে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। ও যখন বড় হবে, তখন চিরকালীন ভারতবর্ষের হাত ধরেই বড় হবে। এই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।’’

যে দিন সন্তানসম্ভবা হন, তখন থেকেই একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে দিন কাটিয়েছেন বলে জানালেন সাজদা। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলে হবে নাকি মেয়ে, আমরা ভাবিইনি। চেয়েছিলাম সন্তান সুস্থ হোক।’’ সাজদার অস্ত্রোপচার করেছিলেন চিকিৎসক পলি চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমাদের কাছে সকলেই সমান। কিছু লোক কেন বিভাজনের চেষ্টা করছে কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কার পদবি কী, কার নাম কী, সেটা দেখে কোনও চিকিৎসকই চিকিৎসা করেন না। সাজদার মেয়ে ও সাজদা, দু’জনেই সুস্থ রয়েছে এতেই আমি খুশি।’’

তার পরেও এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন থেকেই যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না, তখন তোর জরায় ভর করে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি।’ ‘এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি’, এই আক্ষেপ কি এই পরিবর্তিত ভারতের ক্ষেত্রে সত্যি? বিশেষ করে নবজাতকদের ক্ষেত্রে? কবি জয় গোস্বামী বলেন, ‘‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘জরাসন্ধ’ কবিতাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কথা নেই। কিন্তু কারও যদি ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এটি মনে আসে, তা আসতেই পারে। কারণ, কবিতা লেখা হয় এক ভাবে। কিন্তু মহৎ কবিতার চরিত্রই হল তার অর্থ যুগের সঙ্গে পাল্টে যায়। অর্থ বদলের সেই স্বাধীনতা পাঠকের রয়েছে। তবে এই কবিতাটি আমার কাছে শক্তির অবচেতনের উদ্ধার বলে মনে হয়, যা দুর্লভ।’’ একটু থেমে জয় গোস্বামী জানালেন, কিছু দিন আগে কী ভাবে তাঁর নিজের মেয়েই একদল লোকের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মুখে কাপড় বেঁধে, ‘জয় শ্রীরাম’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। জয় এক সময়ে লিখেছিলেন, ‘আমরা শিখি নি। পরে যারা আছে, তারা/ তারা শিখবে না এর ঠিক ব্যবহার?’

জয়ের বিশ্বাস, ‘‘তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদ শুরু করেছে, তারা শিখে নেবে দেশের চরিত্র অক্ষত রাখার কৌশল। কারণ, দেশের মাটিকে পাল্টানোর, বিভাজনের এই নীতি টিকবে না, টিকতে পারে না!’’ সাজদা-জিশানও বিশ্বাস করেন, ‘‘এ পরিস্থিতি সাময়িক। এই অশান্ত, উত্তাল পরিবেশ কাটিয়ে এ দেশ ফিরে যাবে নিজস্ব পরিচয়ে—চিরকালীন ভারতবর্ষে।’’

আর এ ভাবেই প্রজন্মের ফারাক মুছে এক হচ্ছে বিশ্বাস, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর একত্রিত হচ্ছে। সাজদা, জিশা‌ন বলছিলেন, ‘‘এখনও মেয়ের নাম ঠিক করতে পারিনি। শুধু জানি ও হল এ দেশের মেয়ে,

ভারতের মেয়ে!’’

যখন তাঁরা দৃঢ় গলায় কথাগুলি বলছিলেন, তখন মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে আট দিনের ‘ছোট্ট ভারত’!

CAA Narendra Modi Citizenship Amendment Act Hindu Muslim Religion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy