Advertisement
০১ মে ২০২৪
Kunal Ghosh

২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুরবদল কুণালের, অভ্যন্তরীণ তর্কে বিরতি দিয়ে তির ঘোরালেন বিজেপি-সিপিএমের দিকে

কুণাল বিতর্কে সার্বিক বিরতি দিতে চাইলেও মঙ্গলবার দুই নেতা নতুন করে বিতর্ক তৈরি করে বসেছেন। প্রথম জন অশোকগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী এবং দ্বিতীয় জন বরাহনগরের বিধায়ক তাপস রায়।

TMC is an united family, says Kunal Ghosh after the Controversy

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:২৭
Share: Save:

সোমবার বলেছিলেন, দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর বাক্যগঠন নিয়ে তাঁর আপত্তি আছে। দলের প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের ভাব সম্প্রসারণও করতে চেয়েছিলেন। দলের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, অধুনা জেলবন্দি মন্ত্রীকে নিয়ে তিনিই প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অভিমত প্রকাশ করেছিলেন ‘নবীনবরণে’।

মঙ্গলবার তিনিই বললেন, ‘‘ইস্যুভিত্তিক মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু তৃণমূল লড়াইয়ের ময়দানে ঐক্যবদ্ধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেত্রী। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সেনাপতি। যেখানে সুব্রত বক্সীর মতো সিনিয়র নেতারা রয়েছেন। সবাই যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়াবেন, তখন আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’’

সোমবার তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাদিবসের রিংটোন ছিল, ‘দ্বন্দ্ব-দ্বন্দ্ব-দ্বন্দ্ব’। মঙ্গলবারের বাঁশির সুর বলল, ‘ঐক্য-ঐক্য-ঐক্য’।

সোমবার দিনভর নবীন-প্রবীণ প্রসঙ্গে কড়া বিতর্কের পরে সন্ধ্যায় যখন মমতার বাড়িতে দলনেত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেছেন অভিষেক, তখন তৃণমূলের এক রসিক নেতা সুপ্রাচীন এক বাংলা ছবির একদা জনপ্রিয় গানের কলি আউড়ে বলেছিলেন, ‘‘এর পর তা হলে কী হবে? ‘তোরা হাত ধর, প্রতিজ্ঞা কর, চিরদিন তোরা বন্ধু হয়ে থাকবি!’ এটাই তো?’’

কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তা-ই হয়েছে। অন্তত প্রকাশ্যে। তবে কত দিন এই সুর থাকবে, তা তৃণমূলের নেতারাই ঠিকঠাক বলতে পারছেন না। কারণ, কুণাল বিতর্কে বিরতি দিতে চাইলেও মঙ্গলবার দুই নেতা নতুন করে বিতর্ক তৈরি করে দিয়েছেন। প্রথম জন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা অশোকগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী এবং দ্বিতীয় জন বরানগরের বিধায়ক তথা বিধানসভায় তৃণমূলের উপ মুখ্যসচেতক তাপস রায়। নবীন-প্রবীণ বিতর্কে নারায়ণ বলেছেন, ‘‘অনেকে আছেন, যাঁদের সফ্‌টঅয়্যার আপডেটেড নেই। অনেক পুরনো সফ্‌টঅয়্যার। সেটা দিয়ে তো আর হোয়াটস্অ্যাপ চলবে না!’’ আর তাপস নিশানা করেছেন লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রসঙ্গত, গত শনিবার অভিষেকের বাড়িতে যে নেতারা বৈঠক করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন নারায়ণ এবং তাপসও।

ওই বৈঠকে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসুও। যিনি মঙ্গলবার বলেছেন, তিনি কোনও বিতর্ক টেরই পাননি। ব্রাত্যের কথায়, ‘‘হতে পারে ‌আমার গায়ের চামড়া সূক্ষ্ম নয়। সে কারণে টের পাইনি। আর আমি তো প্রবীণও নই, নবীনও নই। এই বিতর্কে আমি মাথা ঘামিয়ে করবটা কী?’’ ব্রাত্যের পাশে বসেই দমদমের প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় জানিয়েছেন, তিনিও বিতর্কের কিছু দেখছেন না। তবে পাশাপাশিই সৌগত আবার বলেছেন, তিনি মনে করেন না, বয়স কখনও রাজনীতিতে ‘মানদণ্ড’ হতে পারে।

তবে এর মধ্যেই মঙ্গলবার তৃণমূলের ‘নবীন ব্রিগেড’ সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা শুরু করে যে, ‘সেনাপতি ছাড়া যুদ্ধ হয় না’। অর্থাৎ, তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক যদি লোকসভা ভোটে ডায়মন্ড হারবারের বাইরে না বেরোন (যেমনটা তিনি গত শনিবার তাঁর বাড়িতে একটি বৈঠকে তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু নেতাকে বলেছিলেন বলেই খবর), তা হলে যুদ্ধ জেতা যাবে না। তৃণমূলের একটি অংশ মনে করছে, এটাও প্রবীণ অংশের উপর একপ্রকার ‘চাপ’ তৈরির চেষ্টা। যে, নতুন প্রজন্ম সেনাপতি অভিষেকের সঙ্গে আছে। তারা মনে করছে, সেনাপতি ছাড়া যুদ্ধ হবে না।

সোমবার দিনভর বিতর্কের পরে সন্ধ্যায় কালীঘাটের বাড়িতে অভিষেকের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মমতা। সেখানে শাসকদলের দুই শীর্ষ নেতানেত্রীর কী আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে কেউই মুখ খোলেননি। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তার পর কুণালের সুর কিছুটা বদলেছে। বস্তুত, মঙ্গলবার কুণাল তির ঘুরিয়েছেন সিপিএম-বিজেপির দিকে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর একটি মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তাঁকে ‘বিজেপির দালাল’ বলে তোপ দেগেছেন তৃণমূল মুখপাত্র। বলেছেন, ‘‘এখন দেখছি বিজেপি-সিপিএমের নেতারা সারা দিন বলছেন, তৃণমূলের অমুক নেতা এই বলেছে! তুসুক নেতা সেই বলেছে! সিপিএম-বিজেপি পুরো তৃণমূলময় হয়ে গিয়েছে। যেন প্রেম উপচে পড়ছে।’’ কুণালের পরামর্শ, ‘‘তৃণমূলের দিকে না তাকিয়ে নিজেরা নিজেদের পার্টির দিকে দেখুন।’’

প্রসঙ্গত, বছর দেড়েক আগে দলের বিভিন্ন বিষয়ে ‘আলটপকা’ মন্তব্য করায় কুণালকে ‘সেন্সর’ করেছিল তৃণমূল। তখন কুণাল বলতেন, ‘‘আমার মুখে অন্তর্বর্তিকালীন স্থগিতাদেশ রয়েছে।’’ এ বার অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। অন্তত প্রকাশ্যে। তবে সুরবদল দেখে তৃণমূলের অনেকে বলছেন, নির্ঘাত সর্বোচ্চ স্তর থেকে ‘বার্তা’ এসেছে।

সোমবার সন্ধ্যায় মমতা-অভিষেকের ঘণ্টা দুয়েক একান্তে বৈঠক হয়েছে। তার পর থেকেই দলের মধ্যে বিবদমান দুই গোষ্ঠী বিতর্কে বিরত থাকার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, ক্রমাগত নবীন-প্রবীণ বিতর্কে যে দলের ক্ষতি হচ্ছে, তা যুযুধান দুই শিবিরকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষত, যে ভাবে দলের প্রতিষ্ঠাদিবসে দলের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর ছায়া পড়েছে, তা অনভিপ্রেত। এর ফলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। তার পর থেকেই ‘মমতা নেত্রী, অভিষেক সেনাপতি’— এই তত্ত্ব আরও জোরালো ভাবে বলা হতে থাকে। বলা হতে থাকে, দু’জনের নেতৃত্বেই বাংলায় বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে লড়াই করবে তৃণমূল। যে কারণে মঙ্গলবার কুণালও বলেন, দলে প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে। সকলেই নিজের নিজের ভূমিকা পালন করবেন। প্রশ্ন উঠেছিল, তৃণমূল পরিবারে সুব্রত বক্সীর ভূমিকা কী? কুণালের জবাব, ‘‘একটা পরিবারে যেমন হয় তেমনই। কারও যদি শারীরিক ও মানসিক জোর কমতে থাকে, তা হলে তাঁর ভূমিকা বদলে যায়। এখানেও তেমনই।’’

ঐক্যের বাঁশি যতই বাজুক, কুণালের ওই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, শরীর-মনের জোর কমলে প্রবীণদের যে জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিত, সেই মূল বক্তব্য থেকে তিনি সরছেন না। ফলে আপাতত শান্তিকল্যাণ হলেও দেখার, এই ‘শান্তিচুক্তি’র মেয়াদ কত দিন থাকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE