ভাগীরথী, জলঙ্গি নদীর ভাঙন তো লেগেই আছে। মুর্শিদাবাদে এখন ভাঙনের গ্রাসে কংগ্রেসও।
মুর্শিদাবাদকে ‘মডেল’ করেই রাজ্য কংগ্রেস বাংলার রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে চায়। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর খাসতালুক সেই মুর্শিদাবাদকেই নিশানা করেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লক্ষ্য একটাই, রাজ্য-রাজনীতিতে কংগ্রেসকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে দেওয়া। সেই লক্ষ্যেই গত বিধানসভা ভোটের ছ’মাস পরে তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভাঙার পর থেকেই কংগ্রেস ভাঙার কাজ শুরু করে তৃণমূল। আর সেই ভাঙন প্রক্রিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদকে।
বস্তুত, ‘অপারেশন মুর্শিদাবাদ’ সফল করতে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ‘সেনাপতি’ শুভেন্দু অধিকারীকে ভার দিয়েছেন মমতা। তমলুকের সাংসদ শুভেন্দুকে মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের পর্যবেক্ষক করা হয়েছে। দায়িত্ব পেয়ে শুভেন্দু পুরসভা থেকে শুরু করে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিদেরই বেছে নিয়েছেন। কারণ, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভাঙার পরেই রেজিনগরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীরকে মন্ত্রী করে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে নিয়ে এসেছিলেন মমতা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। উপনির্বাচনে হুমায়ুনকে হারিয়ে কংগ্রেস রেজিনগর আসনটি ধরে রেখেছে। এরপর সুতির বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু হুমায়ুনের হাল দেখে ইমানি কংগ্রেসের বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে এখন ভোটের মুখোমুখি হননি। তাই বিধায়ক বা সাংসদ না ধরে আপাতত গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ ও পুরসভার নির্বাচিত কংগ্রেস-সহ বিরোধী সদস্যদেরই বেছে নিয়েছেন শুভেন্দু। পাশাপাশি মান্নান হোসেনের মতো কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ, যুব কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সৌমিক হোসেনের মতো বেশ কয়েক জন দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
প্রথমেই তৃণমূল ভেঙেছে ধুলিয়ান পুরসভা। বামেদের হাত থেকে কংগ্রেস এই পুরসভা ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু দল ভাঙনের প্রক্রিয়ায় সেই পুরসভা এখন তৃণমূলের দখলে। তবে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসে বড়সড় ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বুধবার সন্ধ্যাতেই মুর্শিদাবাদের ভরতপুর ও খড়গ্রাম বিধানসভা এলাকার কংগ্রেসের এক জেলা পরিষদ সদস্য খাদেম এ দস্তগীর-সহ শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে শুভেন্দু তৃণমূলে যোগদান করিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘ওই দলত্যাগে সালার, সিমুলিয়া, টেয়া ও মালিহাটি গ্রাম পঞ্চায়েত কংগ্রেসের থেকে তৃণমূলের হাতে চলে এল।’’ এর পরেও আগামী ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নেতা-কর্মী মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার জন কংগ্রেস ছেড়ে তাঁদের দলে যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন।
অধীর অবশ্য এই দল ভাঙনকে প্রকাশ্যে কোনও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁর কথায়: ‘‘দিদির এক হাতে মুগুর, আর এক হাতে গাজর। এক দিকে উনি দল ভাঙাতে নানা প্রলোভন দেখাচ্ছেন। অন্য দিকে দলের মদতে পুষ্ট মস্তানদের দিয়ে সন্ত্রাস করাচ্ছেন। প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে আমাদের দল ভাঙাচ্ছে দিদির লোকজনেরা। ওদের হাতে প্রশাসন আছে। এই চাপের কাছে মাথা নোয়াচ্ছেন আমাদের কেউ কেউ।’’ তবে অধীর-বিরোধী কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই মনে করেন, দলত্যাগের ঘটনার পিছনে দলীয় নেতাদের ‘বিচক্ষণতা ও সকলকে নিয়ে চলার মানসিকতা’র অভাব আছে। মানস ভুঁইয়া, সোমেন মিত্রের মতো প্রবীণ নেতাদের অনেকেই প্রকাশ্যে বলেছেন, দলত্যাগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দলের সবাইকে নিয়ে বসে আলোচনা করা দরকার। কারণ, তাঁদের ব্যাখ্যায়, কেবল মুর্শিদাবাদই নয়, সারা রাজ্যেই দলে ভাঙন হচ্ছে। এটা বন্ধ করা দরকার।
দলত্যাগের হাতিয়ারে ধুলিয়ান পুরসভা তো বটেই, পঞ্চায়েত স্তরেও ক্ষমতা বিস্তার করছে তৃণমূল। শুভেন্দু জানিয়েছেন, গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে তৃণমূলের হাতে ছিল একটি পঞ্চায়েত সমিতি। সাগরদিঘিতে। দলত্যাগের ফলে এখন তাদের হাতে আরও ৬টি সমিতি এসেছে। একই ভাবে ২০১৩-তে জেলার ২৫৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র ৪টি তৃণমূলের হাতে ছিল। শুভেন্দুর দাবি, কংগ্রেস এবং অন্য দল ছেড়ে সদস্যরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় এখন ৮২টি গ্রাম পঞ্চায়েত তাঁরা দখল করছেন। কিন্তু জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র অশোক দাস বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের হাতে ৪০টির বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত নেই। তবে ২০১৩ সালে তৃণমূলের হাতে ২২টা ছিল। আর কংগ্রেসের গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখা ছিল ১২৭টা। পরবর্তী সময়ে অবশ্য কমে ১২২টা হয়েছে।’’ তাঁদের দল ছেড়ে সদস্যরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় কংগ্রেসের হাত ছাড়া হয়েছে পঞ্চায়েতগুলি। জেলা পরিষদেও ৪২টি আসনের মধ্যে দলত্যাগের কারণে কংগ্রেসকে হারাতে হয়েছে চারটি আসন।
অধীর অবশ্য মনে করেন, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস এখনও শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখনও এই জেলায় কংগ্রেসের ১৪ জন বিধায়ক আছেন। সাংসদ আছেন দু’জন। অধীর বহরমপুরের, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় জঙ্গিপুরের সাংসদ। জেলা কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই মনে করেন, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের দুর্গ অটুট থাকবে। কারণ ওখানে কংগ্রেসের একটা ঐতিহ্য আছে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে কংগ্রেসের ভরাডুবির সময়েও মুর্শিদাবাদ থেকে ৬ বিধায়ক জয়ী হয়েছিলেন। অধীরও বলেন, ‘‘যাঁরা দলত্যাগ করছেন বা যাঁরা তাঁদের দল ছাড়িয়ে নিজেদের দলে ঢোকাচ্ছেন, তাঁরা কেন ইস্তফা দিয়ে নতুন করে ভোটে লড়ছেন না? আসলে তাঁদের হিম্মত নেই।’’ আগামী বিধানসভা ভোটে মুর্শিদাবাদে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন অধীর।
সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তৃণমূল কতটা করতে পারবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু এখন বাস্তব পরিস্থিতি হল, মুর্শিদাবাদে রাজনৈতিক জমি তৃণমূল দখল করার চেষ্টা করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy