Advertisement
১৯ মে ২০২৪

জামিন সৃঞ্জয়ের, রাতেই ছাড়লেন হাসপাতাল

সারদা মামলায় গ্রেফতারের ৭৫ দিন পরে জামিন পেলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসু। বুধবার আলিপুর জেলা নগর ও দায়রা আদালতের বিচারক সমরেশপ্রসাদ চৌধুরী শর্ত সাপেক্ষে জামিন দিলেন সৃঞ্জয়কে। সারদা মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়া কোনও ব্যক্তি এই প্রথম জামিন পেলেন।

এসএসকেএম থেকে বেরোচ্ছেন সৃঞ্জয়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

এসএসকেএম থেকে বেরোচ্ছেন সৃঞ্জয়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪০
Share: Save:

সারদা মামলায় গ্রেফতারের ৭৫ দিন পরে জামিন পেলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসু। বুধবার আলিপুর জেলা নগর ও দায়রা আদালতের বিচারক সমরেশপ্রসাদ চৌধুরী শর্ত সাপেক্ষে জামিন দিলেন সৃঞ্জয়কে। সারদা মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়া কোনও ব্যক্তি এই প্রথম জামিন পেলেন। গ্রেফতারের কিছু দিন পর অসুস্থ হয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সৃঞ্জয়। এ দিন জামিন পাওয়ার পরে রাতে তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করায় পরিবারের লোকজন।

বস্তুত, সৃঞ্জয়ের দীর্ঘ হাসপাতাল-বাস নিয়ে এর মধ্যেই বিরোধী-সহ বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, সৃঞ্জয়ের এমন কিছু হয়নি যাতে এত দিন এসএসকেএমে থাকতে হবে। চিকিৎসা জেল হাসপাতালেই করা যেত। হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশ এ দিন প্রথমে জানান, জামিন পাওয়ার পরপরই সৃঞ্জয়কে ছুটি দিলে তাঁকে এত দিন এখানে রেখে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। যদিও রাতে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি এনে এবং হাসপাতালে বন্ড দিয়ে সৃঞ্জয়কে নিয়ে বেরিয়ে যান তাঁর পরিবারের লোকজন।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক সৃঞ্জয়। অভিযোগ, সারদার সংবাদপত্রগুলিকে সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে মোটা অঙ্কের চুক্তি করেন সুদীপ্ত সেন। সিবিআইয়ের সেই অভিযোগের ভিত্তিতে সারদা রিয়েলটি মামলায় গত বছর ২১ নভেম্বর গ্রেফতার হন সৃঞ্জয়। ওই গ্রেফতারের মাত্র চার দিন আগে ১৭ নভেম্বর আদালতে দ্বিতীয় চার্জশিট জমা দিয়েছিল সিবিআই। তাতে নাম ছিল না সৃঞ্জয়ের। তাঁকে গ্রেফতারের পরে নতুন করে আর কোনও চার্জশিট জমা দেয়নি সিবিআই। এমনকী, গত ৭৫ দিন ধরে সৃঞ্জয় জেল হেফাজতে থাকার সময়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রেও তদন্তকারীদের তরফে বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়েনি বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সৃঞ্জয়ের আইনজীবীদের যুক্তি, এর মধ্যেই ৭৫ দিন জেল খেটেছেন সৃঞ্জয়। তদন্তকারীদের সঙ্গে সহযোগিতাও করেছেন। আইনজীবী সঞ্জয় দাশগুপ্ত বলেন, “এই সহযোগিতার কথা আদালতে দাঁড়িয়ে সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারও স্বীকার করেছেন।” তবে এ দিন সঞ্জয়বাবু ও সৃঞ্জয়ের অন্য দুই আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় ও বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়ের হাতে সব চেয়ে বড় অস্ত্র ছিল সিবিআইয়ের চার্জশিট।

আইনজীবীরা জানান, ১৭ নভেম্বর আদালতে জমা দেওয়া সেই চার্জশিট পরের দিন বিচারক গ্রহণ করার সময় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯ নম্বর ধারাটি বাদ দিয়ে দেন। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনও সরকারি কর্মী, ব্যবসায়ী, দালাল বা ব্যাঙ্ক কর্মী যদি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে থাকেন, তবে সে ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। চার্জশিটে বাকি যে ধারাগুলি ছিল, তাতে সর্বোচ্চ ৭ বছরের সাজা হতে পারে। এখানেই শেষ নয়। ওই ৪০৯ নম্বর ধারা থাকলে অভিযুক্তকে গ্রেফতারের ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দিলেও চলে। আর ৪০৯ ধারা না থাকলে ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট জমা না দিলে জামিন পেয়ে যেতে পারেন অভিযুক্ত। এ দিন আইনজীবীদের যুক্তি ছিল, ১৮ নভেম্বর যদি চার্জশিট থেকে ৪০৯ ধারা বাদ চলে যায়, তা হলে সুদীপ্তরা তো বটেই, সৃঞ্জয়ের বিরুদ্ধেও কি এই ধারা প্রযোজ্য হবে? আর তা না হলে এ বারে জামিন পেয়ে যাওয়ার কথা সৃঞ্জয়ের। কারণ, তাঁর ৬০ দিনের বেশি জেল খাটা হয়ে গিয়েছে।

কী বলছে সিবিআই? কেন্দ্রীয় এইগোয়েন্দা সংস্থার মুখপাত্র জানাচ্ছেন, এখনও তদন্তের অনেক স্তর বাকি। এক অভিযুক্ত জামিন পেয়ে গেলে তাই হইচই করার কিছু নেই।

সিবিআইয়ের এই বক্তব্য সত্ত্বেও প্রশ্ন কিন্তু উঠছেই। অনেকেই বলছেন, ৪০৯ নম্বর ধারা বাদ দেওয়ার পরে কেন সিবিআই সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে গেল না? জবাবে সিবিআইয়ের মুখপাত্র কাঞ্চন প্রসাদ দিল্লি থেকে বলেছেন, “আদালতের নির্দেশ আরও খতিয়ে দেখতে হবে। তা ছাড়া এত সহজে দুইয়ে-দুইয়ে চার করবেন না! অনেক পথ পেরনো বাকি।” সিবিআইয়ের আইনি উপদেষ্টা অঙ্কুশ সরকার এবং আইনজীবী পার্থসারথি দত্ত এ দিন আদালতে জামিনের বিরোধিতা করে জানান, অভিযুক্তকে জামিন দিলে তিনি প্রমাণ লোপাট করতে পারেন। দু’পক্ষের সওয়াল শুনে শর্তসাপেক্ষে অভিযুক্তের আবেদন মঞ্জুর করেন বিচারক। শর্ত, তাঁর পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে সিবিআইয়ের কাছে। মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। তদন্তের স্বার্থে সিবিআই যখনই ডাকবে, তখনই হাজির হতে হবে। জামিন হিসেবে এক লক্ষ টাকাও দিতে হবে।

বিরোধীরা যদিও প্রশ্ন তুলতে ছাড়ছেন না। জল্পনা হচ্ছে, সিবিআইয়ের তরফে চার্জশিট এবং তদন্ত প্রক্রিয়ায় ঢিলেমির সঙ্গে কি তৃণমূলের একাংশের দিল্লি যাতায়াতের কোনও সম্পর্ক আছে? সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “সৃঞ্জয় যে ভাবে জামিন পেলেন তাতে প্রশ্ন উঠছে, বাঁচার জন্য দিল্লিতে গিয়ে ধরাধরি করা হয়েছে কি?” সারদা তদন্ত চলাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারে বারেই অভিযোগ করেছেন, সিবিআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বিজেপি। এখন সৃঞ্জয় জামিন পাওয়ায় সিবিআইয়ের উপরে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ করলে মমতার বক্তব্যকেই এক দিক থেকে মান্যতা দেওয়া হয়ে যায় এই আশঙ্কা থেকেই সরাসরি কোনও অভিযোগ করেনি বিরোধী দলগুলি। যাঁর আবেদনের ভিত্তিতে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত হচ্ছে, কংগ্রেসের সেই নেতা আব্দুল মান্নান যেমন বলেছেন, “সিবিআই নিজেরাই সৃঞ্জয়কে গ্রেফতার করেছিল। এমনও হতে পারে যে, ইতিমধ্যে তৃণমূলের ওই সাংসদের কাছ থেকে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সিবিআই পেয়ে গিয়েছে!”

বিরোধীদের আশঙ্কা উড়িয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য বলেন, “কোনও গাফিলতি নিয়ে কারও কিছু বলার থাকলে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন। এখানে কোথাও কোনও সমঝোতার প্রশ্নই আসে না।” সৃঞ্জয়ের দল তৃণমূলের তরফে কেউ অবশ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খোলেননি। তবে ঘরোয়া আলোচনায় দলের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, “সিবিআইকে দিয়ে আমাদের রাজ্যসভার সাংসদদের কী ভাবে নিশানা করা হচ্ছে, সেই অভিযোগ জানাতে শুক্রবার উপরাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার কথা সংসদীয় প্রতিনিধিদলের। তার আগে সৃঞ্জয়ের জামিনের ঘটনায় ভালই হল। সিবিআই যে তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পায়নি, রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে তা-ও বলা যাবে।” এসএসকেএমে কার্ডিওলজির কেবিনে এ দিন সন্ধ্যা থেকেই দেখা যাচ্ছিল প্রায় উৎসবের মেজাজ! গাড়ি ভর্তি লোকজন এসেছেন ফুল নিয়ে। দৃশ্যতই স্বস্তিতে থাকা সৃঞ্জয়কেও তাঁদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা গিয়েছে। রাত ৯টার পরে পরিবার এবং অনুগামীদের সঙ্গেই এসএসকেএম ছেড়ে যান সৃঞ্জয়।

আলিপুরের যে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে সারদা মামলার শুনানি চলছে, সেই হারাধন মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে এর আগে বারবার সৃঞ্জয়ের জামিনের আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে থাকার জন্য কোনও দিনই সৃঞ্জয়কে আদালতে হাজির করানো যায়নি। শেষে বিচারক জানিয়ে দেন, সৃঞ্জয়কে সশরীর হাজির করতে না পারলে জামিনের আবেদন তিনি শুনবেনই না। সেই কারণে, উচ্চতর জেলা নগর ও দায়রা আদালতে এ দিন জামিনের আবেদন জানানো হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam srinjay basu bail sskm
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE