Advertisement
E-Paper

বড়মার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে জয়ের মুখ দেখল তৃণমূল শিবির

এত অপমান করবেন না। এত অসম্মান করবেন না। এত কাসুন্দি ঘাঁটবেন না। ফল জানার পর কথাগুলো পুরুলিয়ায় বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বনগাঁর ঠাকুরনগরে দাঁড়িয়ে তাঁর দলের বিজয়ী প্রার্থী মমতা ঠাকুরও স্বচ্ছন্দে ওই কথাগুলোই বলতে পারতেন। তিনি শুধু বলেছেন, “আমি আর কী বলব, মতুয়া ভক্তেরাই সব জবাব দিয়ে দিয়েছেন।”

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:৪০
ফল ঘোষণার পরে আবিরে রঙিন মমতা ঠাকুর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

ফল ঘোষণার পরে আবিরে রঙিন মমতা ঠাকুর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

এত অপমান করবেন না। এত অসম্মান করবেন না। এত কাসুন্দি ঘাঁটবেন না।

ফল জানার পর কথাগুলো পুরুলিয়ায় বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বনগাঁর ঠাকুরনগরে দাঁড়িয়ে তাঁর দলের বিজয়ী প্রার্থী মমতা ঠাকুরও স্বচ্ছন্দে ওই কথাগুলোই বলতে পারতেন। তিনি শুধু বলেছেন, “আমি আর কী বলব, মতুয়া ভক্তেরাই সব জবাব দিয়ে দিয়েছেন।”

ভোটের আগে মমতাকে নিয়ে বিজেপি যে ভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করেছিল, ভোটের ফল বেরোতে দেখা গেল, তা কোনও কাজে আসেনি। মমতার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ভুয়ো তথ্য দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল বিজেপি। ‘মমতার শরীরে মতুয়া রক্ত বইছে না’ বলে বার বার প্রচার করা হয়েছে। মমতা ঠাকুরকে মতুয়া বাড়িতে ‘বহিরাগত’ বলে প্রমাণের তোড়জোড় করা হয়।

কিন্তু সে সব কিছুই ধোপে টেঁকেনি। বরং মতুয়াদের একটি অংশের মধ্যে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়াই পড়ে। আশিস হীরা, নরোত্তম বিশ্বাসদের মতো মতুয়া ভক্তের কথায়, “বার বার এ কথা বলে আক্রমণ করা হয়েছে ওঁকে (মমতা ঠাকুর)। কিন্তু উত্তরাধিকার রক্তে হয় না। ভক্তি দিয়ে হয়। ওঁর বিরুদ্ধে এ সব বলায় জেদ আরও বেড়েছে।”

সুব্রতর বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ তো তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার পরেই বলতে শুরু করেন, তাঁর দাদা কপিলের মৃত্যু স্রেফ রোগে ভুগে হয়নি। রহস্যজনক ভাবে মারা গিয়েছেন কপিল। যার সিবিআই তদন্ত হওয়া উচিত। এ সব অভিযোগ তুলে মমতা ঠাকুরকেই চাপে ফেলতে চেয়েছিলেন মঞ্জুল। মমতা অবশ্য এ সব কুৎসার কোনও জবাব দেননি। তাঁর জোর ছিল একটাই, শাশুড়ি বীণাপানি দেবী। যিনি বরাবরই বড় বৌমার পাশে ছিলেন।

বড় ছেলে মারা যাওয়ার পরে বৌমাকে নিয়ে শাশুড়ি বলেছিলেন, “ও বড় দুঃখী, ওর তো আর কিছু নেই!” মতুয়া ভক্তদের উদ্দেশে সে দিন বড়মার বার্তা ছিল, “ভোটটা ওকেই দিও। আমার আর্শীবাদ ওর সঙ্গে আছে।” মতুয়া ভক্তরা স্পষ্টতই বড়মার কথা রেখেছেন।

তাঁর নাম তৃণমূলের পক্ষ থেকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করার পরে মমতা ঠাকুর এক দিন সময় চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার মতুয়া ভক্তদের সঙ্গে কথা বলেই জানাবেন। বাস্তবিকই মতুয়া ভক্ত সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পরেই মত দিয়েছিলেন মমতা ঠাকুর। বাকিটা ইতিহাস। সারদা-কাণ্ডের দীর্ঘ ছায়ায় যখন একের পর এক শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী জেলে যাচ্ছেন, তখন তৃণমূলের এই ফল নিঃসন্দেহে দলকে নতুন অক্সিজেন জোগাবে। সব মিলিয়ে খুশি এ বার ভোটের মূল কাণ্ডারী, জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।

কিন্তু কোন জাদুতে এমন ফল?

প্রার্থীর নাম ঘোষণার আগে থেকেই কার্যত গা ঘামাতে শুরু করেছিলেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এক-দু’জন বিধায়ককে একে একেকটি বিধানসভা এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁরাও রীতিমতো মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সেই দায়িত্ব সামলেছেন। দু’টি এলাকার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়। গোবরডাঙার নেতা শঙ্কর দত্ত, রাজীব দত্ত, গাইঘাটার ধ্যানেশনারায়ণ গুহ, বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস, দলের নেতা গোবিন্দ দাসদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই ভোট।

ভোটের দিনও তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি এবং কৌশল কাজে লেগেছে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপাণিদেবীকে (বড়মা) সাত সকালে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র রেখে তাঁকে দিয়ে ভোট দেওয়ানোর ব্যবস্থা করে তৃণমূল নেতারা।তড়িঘড়ি ভোররাতে বড়মাকে ঠাকুরবাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করে ভোটের ময়দানে এক কথায় মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়বাবুরা। মাকে বাড়িতে দেখতে না পেয়ে সে দিন সকালে ছোট ছেলে মঞ্জুলের হম্বিতম্বি দেখে মনেই হচ্ছিল, বড়সড় তুরুপের তাস হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।

কপিলের অকালপ্রয়াণে মতুয়া সমাজের একটা বড় অংশের ‘সহানুভূতি ভোট’ অবশ্যই পেয়েছেন মমতা ঠাকুর। তবে জেতার ব্যবধানটা যে এত হবে, তা নিজেও ভাবেননি তৃণমূল প্রার্থী। মমতা ঠাকুরের কথায়, “৯৫ শতাংশ মতুয়াদের ভোট আমিই পেয়েছি। আমার স্বামীর থেকে বেশি ভোট পাব ভেবেছিলাম, তবে সেটা এতটা হবে, সেটা সত্যিই ভাবিনি।” তবে এই জয় ‘মতুয়া ভক্ত এবং তৃণমূল কর্মীদের জয়’ বলেন তিনি।

মমতা ঠাকুর বনাম বিজেপি প্রার্থী সুব্রত ও তাঁর বাবা মঞ্জুলের ভাবমূর্তির লড়াইও তৃণমূলকে বাড়তি সাহায্য করেছে বলাই চলে। একে তো মঞ্জুলদের পাল্টা মতুয়া মহাসঙ্ঘ গড়ে তার সঙ্ঘাধিপতি হয়ে মমতা মতুয়াদের একটা বড় অংশের সমর্থন পেয়েছেন। তার উপরে, ভোটের ঠিক আগে মঞ্জুলের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানও একটা অংশের ভোটাররা ভাল চোখে নেননি। সুব্রতও ছিলেন তৃণমূল শিবিরে। তিনিও যে স্রেফ ভোটের টিকিট পেতেই তৃণমূলে গিয়েছেন, এই প্রচারটা সুকৌশলে মানুষের মনে গেঁথে দিতে পেরেছে তৃণমূল। তার উপর গত কয়েকটি ভোটের মতোই এ বারও বামেদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত। সেই ভোটের একটা বড় অংশ শাসক দলের সঙ্গেই গিয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশ তাদের পক্ষে থেকেছে। সব মিলিয়ে ভোটের এই ফল।

ভোটের দু’দিন আগে দিল্লির ভোটে বিজেপির পরাজয়কে সামনে রেখে শেষবেলায় জোর প্রচার সেরেছে তৃণমূল। কেন্দ্রে প্রবল প্রতাপে ক্ষমতায় এলেও বিজেপির জয়ের রথকে যে রুখে দেওয়া সম্ভব, দিল্লি তা দেখিয়ে দিয়েছে বলে প্রচারে বারবার বলেছেন তাঁরা। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়দের মতো হেভিওয়েট কয়েক জনকে বাদ দিলে কার্যত তৃণমূলের সব নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদ বনগাঁর ভোটের জন্য সময় দিয়েছেন। যার সুফল মিলেছে ইভিএমে।

simanta maitra arunakksha bhattacharyay manjulkrishna thakur subrata thakur bangaon by election mamatabala thakur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy