Advertisement
E-Paper

রাস্তা ডুবেছে, কয়েক ক্রোশ গাড়ি ঠেলে বিয়ে

রোববার সন্ধেয় কনে নিয়ে ফিরে বরের ঘরের কাকলি বিবি, ববিতা বিবিরা অবশ্য ঠোঁট বাঁকাচ্ছেন, ‘‘যা বিয়ে খেয়ে এলাম গো, যদ্দিন বাঁচব, ভুলব না!’’ শুনে, কনের মা সনজিদা বিবির মুখ ভার— ‘‘সবই কপাল। গাঁয়ের রাস্তার জন্য মেয়েটাকে আমার সারা জীবন খোঁটা শুনতে হবে!’’

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৫৯
দুর্ভোগ: বিয়ে বাড়ির রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।

দুর্ভোগ: বিয়ে বাড়ির রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।

হরিহরপাড়কাদা থিকথিকে রাস্তা। আগে-আগে চলেছে গাড়ি, পিছনে ঠেলতে-ঠেলতে বরযাত্রী। কোঁচাকাচা গুটিয়ে, তোয়ালে পরে চলছে গাড়ি ঠেলা— চলো জোয়ান, হেঁইও...

একেবারে সামনে বরের গাড়ি। তার পিছু-পিছু একটার পর একটা, বরযাত্রী তো কম নয়, আশি জন! গাড়ি একটু স্টার্ট নিল তো হইহই করে চেপে বসা, তার পর যেই গাড্ডায় পড়ল, আবার নেমে ঠেলা। জামা-জুতো কাদায় মাখামাখি।

অঘ্রানের সকালে মেঘ মাথায় বর বেরিয়েছিল হরিহরপাড়ার মালোপাড়া থেকে। কনের বাড়ি ১৮ কিলোমিটার দূরে বলরামপুরে। পাকা রাস্তা ধরে অনেকটা গিয়ে বারুইপাড়া থেকে রাস্তা ডাইনে বাঁক নিতেই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক। চাকা সেঁধিয়ে গিয়েছে কাদায়। গাড়ি আর যাবে না!

কনের বাড়িতে ফোন গেল— বর আসতে পারছে না। শুনেই কনের বাবা সাইনুল ইসলাম কাঁদো-কাঁদো, ‘‘এই ছ’কিলোমিটার রাস্তা মাটির। বর্ষায় বিয়ে হয় না এ গাঁয়ে। তাই বর্ষায় রেজিস্ট্রি করিয়েও অঘ্রানে বিয়ে ঠিক করেছিলাম। আমি কী করি!’’

পাত্রের বন্ধুবান্ধবেরা গাড়ি থেকে বেরিয়ে সিগারেট টানছেন আর চোখ কপালে তুলে ভাবছেন, কী করা যায়। দলের মহিলারা এগিয়ে এসে দিলেন ধ্যাতানি— ‘‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? বলি, বিয়েটা হবে নাকি হবে না?’’ দুপুর তিনটেয় মৌলবি বিয়ে পড়াবেন। তার মধ্যে পৌঁছতে না পারলে গেল ফস্কে! এই মওকায় ফস করে বিড়ি ধরিয়ে বরের ড্রাইভার হাঁক দিলেন— ‘গাড়ি ঠেলুন, গাড়ি ঠেলুন। নইলে কনেকে এখানে আনতে হবে!’

ব্যস, শুরু হয়ে গেল কাদার সঙ্গে কুস্তি। সামনে গাড়ি, ভিতরে শাড়ি (মহিলারা বকুনি লাগিয়েই গাড়িতে উঠে পড়েছিলেন), পিছনে এক দল আনাড়ি পিছল খেতে-খেতে চলল কনে সুইটি খাতুনের বাড়ির দিকে। যে যা ‘ইশটাইল’ মেরে এসেছিল, সব চৌপাট! কত দূর, আর কত দূর... শেষে দূরে দেখা গেল ম্যারাপ— ওই তো বিয়েবাড়ি। এসে গেছি!

কোথায় কী!

সামনে তিনশো মিটার আর রাস্তা নেই বললেই চলে। খালি জল আর কাদা। ঠেললেও গাড়ি এগোবে না। কী আর করা। নামো, নামো! ছপছপিয়ে কাদা মেখে বরযাত্রী পৌঁছল। সবার হাল দেখে হাহাকার করে উঠলেন কনের বাবা— ‘‘ছি ছি, শীতে বিয়ে ঠিক করেও এই হাল!’’

চা এল। জলখাবার এল। হাত-মুখ ধুয়ে খানিক ধাতস্থ হলেন সকলে। বিয়ে চুকল হইহই করে। দুপুরে কব্জি ডুবিয়ে ভূরিভোজ হল। এ বার ফেরার পালা। আশি জন বরযাত্রীর সঙ্গে ফাউ একটি কনে। যাওয়ার কথা ভাবলেই সকলের খাবার হজম হয়ে যাওয়ার জোগাড়! কনের চোখেও জল। শেষে রানি কালারের বেনারসি দুলিয়ে কাদা মাড়িয়ে হাঁটা লাগাল সুইটি।

রাস্তা পাকা করার দাবিতে গত বিধানসভা নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন এলাকার মানুষ। আশ্বাস মিলেছিল, ভোট পেরোলেই রাস্তা হবে। যথারীতি হয়নি। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের আহ্বায়ক মোশারফ হোসেন মধু অবশ্য মঙ্গলবার বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় দু’কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। শিগগির কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’

রোববার সন্ধেয় কনে নিয়ে ফিরে বরের ঘরের কাকলি বিবি, ববিতা বিবিরা অবশ্য ঠোঁট বাঁকাচ্ছেন, ‘‘যা বিয়ে খেয়ে এলাম গো, যদ্দিন বাঁচব, ভুলব না!’’ শুনে, কনের মা সনজিদা বিবির মুখ ভার— ‘‘সবই কপাল। গাঁয়ের রাস্তার জন্য মেয়েটাকে আমার সারা জীবন খোঁটা শুনতে হবে!’’

Road Condition Mud Rain Marriage Ceremony
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy