Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
কঙ্কাল-কাণ্ড
haringhata

কয়েক মাস মায়ের কঙ্কাল আগলে ছেলেরা, রবিনসন স্ট্রিটের শিহরণ হরিণঘাটায়

বড় বাগান আর গাছগাছালি ঘেরা দু’কামরার বাড়িটাকে ঘিরে দীর্ঘ দিন ধরেই পাড়ার মানুষের কৌতুহল ছিল। কারণ, বাড়ির প্রবীণ সদস্য বৃদ্ধাকে বাড়ির বাইরে দেখা যাচ্ছিল না বেশ কয়েক মাস ধরেই।

পড়ে রয়েছে ননীবালাদেবীর কঙ্কাল।

পড়ে রয়েছে ননীবালাদেবীর কঙ্কাল।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
হরিণঘাটা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১৯:৫১
Share: Save:

বড় বাগান আর গাছগাছালিতে ঘেরা দু’কামরার বাড়িটাকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই পাড়ার মানুষের কৌতূহল ছিল।

ও বাড়ির বাসিন্দা বলতে দুই ভাই অরুণ ও অজিত সাহা এবং তাঁদের মা ননীবালাদেবী। বিয়ে করেননি দুই ভাইয়ের কেউই। অরুণ এলাকায় কিছু টিউশন পড়াতেন। সংসার চলতো তাতেই। কিন্তু বেশ কয়েক মাস হল তাঁদের বৃদ্ধা মাকে আর বাড়ির বাইরে দেখা যেত না। পাড়ার লোকে জিজ্ঞাসা করলে, দু’জনেই ঘাড় নেড়ে জানাতেন— ‘মা ভালই আছেন’। কিন্তু ভালই যদি থাকেন, তা হলে দেখা যায় না কেন! সন্দেহটা জেগেছিল অনেকের মনেই।

রবিবার তাই পাড়ার জনা আষ্টেক লোক হানা দেয় সাহা-বাড়িতে। বলা হয়, ভোটার কার্ড সংশোধনের জন্য তাঁদের মায়ের টিপ ছাপ দরকার। সটান ‘না’ বলে দেন দুই ভাই। বাধাও দেন। জানান, অসুস্থ বলে মাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু, তাঁদের কথায় কর্ণপাত না করে শেষ পর্যন্ত এক রকম জোর করেই ঘরে ঢুকে পড়েন এলাকার লোকজন।


দুই ভাই, অজিত ও অরুণ সাহা।

তার পর তাঁরা যা দেখেন, তা এমন— ছোট্ট চৌকিটার উপর যাঁকে মা বলে কম্বল চাপা দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে, সেটা স্রেফ একটা নরকঙ্কাল।

হরিণঘাটা পুরসভার শ্রীমাঠের এই ঘটনা ফিরিয়ে দিয়েছে গত বছরের জুন মাসের কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের স্মৃতি। উচ্চবিত্ত ঘরের যুবক পার্থ দে ছ’মাস ধরে দিদি দেবযানী দে-র কঙ্কালের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। নিয়ম করে দিদিকে খাবারও দিতেন তিনি। এই ঘটনায় অনেকে আলফ্রেড হিচককের সিনেমা ‘সাইকো’র ছায়া দেখেছিলেন। ‘সাইকো’র নর্ম্যান বেটস তাঁর মা নর্মা-র কঙ্কালে পোশাক আর পরচুলো পরিয়ে সেলারে রেখে দিয়েছিল।


শ্রীমাঠের সেই বাড়ি।

রবিবার দুপুরে এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর চড়-থাপ্পর পড়ে অরুণ ও অজিতের উপর। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে পুলিশ ডাকেন হরিণঘাটা পুরসভার পুরপ্রধান রাজীব দালাল। পুলিশ এসে উদ্ধার করে সেই কঙ্কাল, যা তাঁদের মৃত মা ননীবালা সাহা (৮৬)-র বলে জানিয়েছে দুই ভাই।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, ননীবালাদেবীর স্বামী কুঞ্জমোহন সাহা বেঙ্গল কেমিক্যালে চাকরি করতেন। বছর কুড়ি আগে মৃত্যু হয় তাঁর। বাড়ির উঠোনে তিনি আর একটি পাকা বাড়ির ভিত করে গিয়েছিলেন। সেই বাড়ি অসমাপ্ত অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। অরুণবাবু বিএসসি পাশ করে চাকরি পাননি। এলাকায় টিউশন পড়াতেন। পাড়ায় তাঁর অসংখ্য ছাত্র। ছোট ভাই অজিত অবশ্য কাজকর্ম কিছুই করতেন না।

অরুণবাবুর ছাত্র সুজিত চক্রবর্তী জানান, বছর দশেক আগে ছাত্র পড়ানো বন্ধ করে দেন ৬৫ বছরের অরুণ। তার পর থেকেই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। ধীরে ধীরে এলাকায় সবার সঙ্গেই সম্পর্ক ছেদ করেন তাঁরা। এমনকী, পাড়ারই বাসিন্দা, তাঁদের মামা বিমল সাহা-র সঙ্গেও কোনও যোগাযোগই ছিল না তাঁদের। তবুও রাস্তাঘাটে দেখা যেত। বাড়ির বাইরে চোখে পড়ত ননীবালাদেবীকেও।


ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে আধখাওয়া খাবার, ফয়েল।

এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সবিতাব্রত শীল জানালেন, বছর খানেক হল ননীবালাদেবীকে আর দেখা যেত না। অরুণবাবুকেও বাড়ির বাইরে বিশেষ দেখা যেত না। তবে অজিতকে মাঝেমধ্যেই মুড়ির প্যাকেট হাতে রাস্তায় দেখা যেত। মায়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘‘ভালই আছে মা।’’

দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের এমন কাণ্ডকারকানা দেখে সন্দেহ হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। সবিতাব্রবাবু বলেন, ‘‘এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ আমরা কয়েক জন ওঁদের বাড়িতে যাই। নাম ধরে ডাকতেই বেরিয়ে আসে দুই ভাই। কিন্তু ওঁরা কিছুতেই বাড়ির ভিতরে যেতে দিচ্ছিলেন না।’’ পাড়ারই বাসিন্দা তরুণ ঘোষ জানান, তাঁরা বলেন, ভোটার কার্ড সংশোধনের জন্য ননীবালাদেবীর টিপ ছাপ দরকার। তাতে না বলে দেন দুই ভাই। কিন্তু এক রকম জোর করেই তাঁরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েন।

সবিতাব্রতবাবু বলেন, ‘‘ঘরের ভিতর ঢুকে দেখি অন্ধকার। ওরা বলে মা ঘুমোচ্ছে। জেগে গেলে আমাদের গালাগালি করবে। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেখি, তক্তপোষের উপরে কম্বল চাপা দেওয়া কিছু একটা পড়ে রয়েছে। কম্বল তুলে দেখি নরকঙ্কাল। খানিক ক্ষণ মুখে কোনও কথা সরেনি।’’

খবর ছড়িয়ে পড়ে নিমেষে। ভিড় জমে যায় বাড়িতে। আসে পুলিশ। কিছুতেই পুলিশের সঙ্গে যেতে চাননি দুই ভাই। পাড়ার লোকেরা চ্যাংদোলা করে তাঁদের পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন।

বহু পুরনো বাড়িটির জরাজীর্ণ দশা। বারান্দার এক কোনে সাজিয়ে রাখা জ্বালানি কাঠ। উনুন যে দীর্ঘদিন ধরেনি, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে চারদিকে ছড়ানো কিছু ফয়েল বক্স। খাবার আনা হয়েছিল, তারই চিহ্ন। চারদিকে নোংরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অরুণবাবুর পরণে কেবল একটি গামছা। জানালেন, তাঁর কোনও জামা-কাপড় নেই। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে।


পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে অরুণবাবুকে।

অবশ্য এমনটা হওয়ার কথা নয়। বাড়ি লাগোয়া চাষের জমি রয়েছে। পুকুরে মাছ রয়েছে। প্রচুর গাছ রয়েছে। বছর কয়েক আগে তার কয়েকটি বিক্রিও হয়েছিল। এলাকার এক বাসিন্দা জানালেন, ফিক্সড ডিপোজিটের কিছু কাগজ রয়েছে। কিন্তু সে সব ভাঙাতেও যেতেন না তাঁরা। অরুণবাবুর এক ছাত্র বললেন, ‘‘মাস্টারমশাই যে এমন কাজ করতে পারেন, ভাবতেও পারছিনা। উনি খুব ভাল পড়াতেন।’’

পুলিশ দুই ভাইকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অরুণবাবু পুলিশকে জানান, এ বছর ১৬ জানুয়ারি তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু, পাড়ার কাউকে সে কথা জানালেন না কেন? অরুণবাবু বলেন, ‘‘আমার দাঁতে ব্যাথা, ভাইয়ের পায়ে ব্যাথা। আমরা কী করে মায়ের কাজ করব? আর দু’দিন পরে দেখলাম ‘বডি’তে পোঁকা ধরেছে, তাই আর কাউকে জানাইনি।’’

থানায় এনে দু’জনকে ভাত খাওয়ায় পুলিশ। ভাত-ডাল-তরকারি-মাছের ঝোল খেয়ে অজিতবাবু বলেন, ‘‘এক বছর পর ভাত খেলাম। আর দুটো ভাত হবে স্যার?’’ তা হলে খেতেন কী? অরুণবাবুর জবাব, ‘‘কেন, মুড়ি!’’

আরও পড়ুন: রাস্তায় প্রসব সোনামণির, আর্তি শুনেও মুখ ফিরিয়ে থাকল লাতেহার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

deadbody Mother Haringhata living with skeleton
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE