Advertisement
১৯ মে ২০২৪

গোষ্ঠী-বিবাদ লাগামছাড়া, নানুর নিয়ে বিব্রত তৃণমূল

বিষবৃক্ষ যে শাখা বিস্তার করছে, বীরভূমের ঘটনায় তা টের পেয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেট ব্যবসা থেকে শুরু করে, বর্ধমানে বালি খাদানের দখল নিয়ে গত কয়েক বছরে শাসক দলের নেতাদের অনুগামীদের গোষ্ঠী লড়াই প্রকাশ্যে এসেছে।

কাজল শেখ এবং ফিরহাদ হাকিম

কাজল শেখ এবং ফিরহাদ হাকিম

নিজস্ব সংবাদদাতা
বোলপুর ও কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৯
Share: Save:

বিষবৃক্ষ যে শাখা বিস্তার করছে, বীরভূমের ঘটনায় তা টের পেয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেট ব্যবসা থেকে শুরু করে, বর্ধমানে বালি খাদানের দখল নিয়ে গত কয়েক বছরে শাসক দলের নেতাদের অনুগামীদের গোষ্ঠী লড়াই প্রকাশ্যে এসেছে। বর্ধমানের খণ্ডঘোষে বালি খাদানের দখল নিয়ে খুনোখুনিও হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা আগে বোলপুরের নিমতলা এলাকায় তিন নেতা-কর্মীর খুনে দলীয় বিধায়ক গদাধর হাজরা এবং জেলা নেতা কাজল শেখের অনুগামীদের জড়িয়ে পড়া তৃণমূল নেতৃত্বের বিড়ম্বনা ও উদ্বেগ বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনায় দোষীদের গ্রেফতার করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা পুলিশ সুপারকে ফোনে নির্দেশ দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। ওই ঘটনায় অভিযোগের তির কাজল শেখের অনুগামীদের দিকে। কাজলকেও কি গ্রেফতার করা হবে? তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম অবশ্য বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নির্দিষ্ট করে কারও নাম বলেননি। তিনি বলেছেন, দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।’’

ওই খুনের ঘটনায় কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের ভাই কাজল শেখ-সহ ২২ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন নিহত কুরবান শেখের বাবা জিলাই শেখ। ঘটনার পরে সোমবার রাতেই আটক করা হয় পাঁচ জনকে। মঙ্গলবার আদালতে তোলা হলে বোলপুরের এসিজেএম ধৃতদের চার দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। পাঁচ জনের মধ্যে চার জন— শেখ নিজারুল, শেখ হাকিম, শেখ ইদবক্স এবং রফিকুল শেখের বাড়ি বোলপুর থানার বড় শিমুলিয়া গ্রামে। আর নফেজ খানের বাড়ি নানুর থানার পাপুড়ি এলাকায়। ধৃত সকলেই এলাকায় কাজল শেখের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কর্মী বলেই পরিচিত।

বীরভূমের ঘটনা নিয়ে ববি এ দিন অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলেননি। তবে সোমবার বিধানসভায় তাঁর সঙ্গে দলের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর নেতা কাজল এবং গদাধর হাজরার আলোচনার অব্যবহিত পরেই খুনের ঘটনা ঘটায় তিনি কিছুটা হতবাক। দলীয় এক সূত্রে জানা গিয়েছে, বিধানসভা ভোটের আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে দলনেত্রীর নির্দেশেই ববির ঘরে ওই বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও কাজল এবং গদাধরের বাগবিতণ্ডায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ববি তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দিলেও, দলের রাজ্য নেতাদের অনেকেই মনে করেন, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নেতৃত্বকে কড়া হতে হবে। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে সমাজবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্তদের অবিলম্বে দল থেকে বিচ্ছিন্ন করা দরকার। এক নেতার কথায়, ‘‘ধরা যাক, দল থেকে ৫০০ জনকে বের করে দিতে হবে। তা হলে সেটাই করতে হবে। কারণ, তা না হলে, দলের দিকে যে আর ৫ লাখ লোক তাকিয়ে আছে, তাদের সমর্থন আমরা হারাব।’’

গদাধর বনাম কাজলের ঠাণ্ডা লড়াই এ দিনও আলোচ্য বিষয় ছিল নানুরের মোড়ে মোড়ে। এক সময় কাজলের সঙ্গে একই মেরুতে থাকলেও পরে অনুব্রতে আনুগত্য দেখান গদাধর। সোমবার নিহতদের মধ্যে কুরবান শেখ এলাকায় গদাধর অনুগামী হিসাবে পরিচিত। কাজলের গ্রামেরই বাসিন্দা, একদা সিপিএম কর্মী কুরবানদের খুনের জায়গা থেকে যে অ্যাম্বুল্যান্সটি মিলেছে, সেটি তৃণমূল পরিচালিত চারকলগ্রাম পঞ্চায়েতের। স্থানীয় সূত্রে খবর, অ্যাম্বুল্যান্সটি কাজলের দুর্গ তৃণমূল পার্টি অফিসেই থাকত। যদিও চারকলগ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান মমতাজ বেগম বলেন, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্স পঞ্চায়েত অফিসে থাকত।’’ এ দিন পাপুড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা মেলেনি অ্যাম্বুল্যান্সের চালক মাখন শেখের। তার বাড়ি তালা বন্ধ। সে পলাতক। দেখা মেলেনি কুরবানের পরিবারেরও। তাঁদের বাড়ির ভগ্ন দশা। গ্রামেরই বাসিন্দা তার এক মামা বাবলু শেখ বলেন, ‘‘ওরা প্রায় ৬ বছর ধরে সপরিবার ঘরছাড়া।’’

সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা অভিযোগ করেন, ‘‘শুধু ওই পরিবারই নয়, তৃণমূলের সন্ত্রাসে নানুরে আমাদের দলের ৬০০টি পরিবার দীর্ঘদিন গ্রামছাড়া। যারা গ্রামে আছেন, তাদেরও মোটা টাকা জরিমানা দিয়ে চাপের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে।’’ কাজল ওই অভিযোগ মানেননি। তিনি বলেন, ‘‘গ্রামে থাকার জন্য কাউকে জরিমানা বা চাপ দিয়ে কিছু করানো হচ্ছে না। আসলে সিপিএম ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের কিছু দুষ্কৃতী গ্রামের মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছিল। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর তাঁদের কেউ কেউ হয়তো অত্যাচারিত ওই সব গ্রামবাসীদের ভয়েই গ্রামে ঢুকতে পারছেন না। তাঁরা চাইলে আমরা তাঁদের গ্রামে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেব।’’

আততায়ীরা অ্যাম্বুল্যান্সে করে কেন হামলা চালাতে গিয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন উঠেছে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘‘আততায়ীরা সম্ভবত ভেবেছিল, লাশগুলি অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে অন্যত্র নিয়ে ফেলে দেবে। কিন্তু আশপাশের লোকজন এসে পড়ায় সেটা হয়তো সম্ভব হয়নি।’’ দলের একাংশের মতে, বিধায়ক তহবিলের টাকায় কেনা অ্যাম্বুল্যান্সে করে হামলাকারীরা গিয়েছিল মানুষকে বিভ্রান্ত করতে।

বোলপুরের ঘটনায় শাসক দলকে কটাক্ষ করে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক ও এ রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় এ দিন কলকাতায় বলেন, ‘‘তৃণমূল দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি করে। তা শুধু অন্য দলের কর্মীদের খুন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন নিজেদের দলে গোষ্ঠী কোন্দলেও তার প্রতিফলন ঘটছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE