Advertisement
E-Paper

বুদ্ধপূর্ণিমায় বুড়োরাজের বন্দনা

প্রায় সকলেরই হাতে অস্ত্র। কারও হাতে রাম দা তো কারও হাতে খাঁড়া। কেউ তরোয়াল উঁচিয়ে তো কেউ আবার তীর-ধনুক। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, দলবদ্ধ হয়ে তারা মধ্য যুগের কোনও যুদ্ধে চলেছে। কিন্তু, যুদ্ধ নয়! গোটাটাই শান্তি কামনায়। এবং সকলেরই গন্তব্য বুড়োরাজের মন্দির। বর্ধমান জেলার সবুজে ঘেরা ছোট একটা গ্রাম জামাপুর। বৈশাখের দাবদাহ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ এ ভাবেই জড় হন সেখানে।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ১৭:৪৭
অস্ত্র হাতে ভক্তরা। গন্তব্য বুড়োরাজের মন্দির।

অস্ত্র হাতে ভক্তরা। গন্তব্য বুড়োরাজের মন্দির।

প্রায় সকলেরই হাতে অস্ত্র। কারও হাতে রাম দা তো কারও হাতে খাঁড়া। কেউ তরোয়াল উঁচিয়ে তো কেউ আবার তীর-ধনুক। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, দলবদ্ধ হয়ে তারা মধ্য যুগের কোনও যুদ্ধে চলেছে। কিন্তু, যুদ্ধ নয়! গোটাটাই শান্তি কামনায়। এবং সকলেরই গন্তব্য বুড়োরাজের মন্দির। বর্ধমান জেলার সবুজে ঘেরা ছোট একটা গ্রাম জামাপুর। বৈশাখের দাবদাহ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ এ ভাবেই জড় হন সেখানে। কেউ এই সব অস্ত্র দিয়ে দেবতার উদ্দেশে বলি দিতে আসেন তো কেউ বা আবার দলবদ্ধ হয়ে অস্ত্র প্রদর্শন করে বীরত্ব দেখাতে। দিনটির একটা মাহাত্ম্য আছে যে! বুদ্ধ পূর্ণিমা বলে কথা! বুড়োরাজের মন্দিরে এ দিন মহামেলা বসে। প্রতি বছর তাই এই দিনে বদলে যায় পরিচিত গ্রামের ছবিটা।

শিব এবং যম-ধর্মরাজের এক মিলিত রূপ এই বুড়োরাজ। অন্যান্য প্রচলিত মেলার চেয়ে গ্রামীণ এই মেলা একেবারেই আলাদা। শহুরে যান্ত্রিক প্রভাব আজও থাবা বসাতে পারেনি এখানে। আর তাই বিরল এবং লুপ্তপ্রায় রীতি রেওয়াজ দেখতে আজও ভিড় করেন উৎসুক মানুষ।

মন্দির বলতে একটি খড়ের চালাঘর। যার মেঝেটি আজও মাটির। সেখানে মাটির কিছুটা নীচে দেখা যায় বিগ্রহ। দু’টি গৌরীপট্ট যুক্ত একটি মূর্তি। তার এক দিকে শিবলিঙ্গ অপর দিকে একটি গর্ত। মাটির কিছুটা নীচে থাকায় এর চেয়ে বেশি বোঝা যায় না। তবে অন্যান্য জায়গার ধর্মরাজের বিগ্রহের মতো এটি কূর্মাকৃতি নয়।

মন্দিরের সেবায়েৎ তথা পুরোহিত সত্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, আনুমানিক ছ’শো বছর আগে এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গলে ছিল একটি উঁইয়ের ঢিপি। শোনা যায়, প্রতি দিন একটি গাই সেই উঁইয়ের ঢিপির উপর এসে দাঁড়াত। আর আপনা থেকেই উঁইয়ের ঢিপির উপরে দুধ পড়ত। সেই গরুর মালিক যদু ঘোষ এক দিন তার পিছু নিয়ে এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে আবাক হয়েছিলেন। সেই রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, ওখানেই দেবতার অধিষ্ঠান। পর দিন সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে শিবলিঙ্গ-গৌরীপট্ট-সহ পাথরের অদ্ভুত এক বিগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু, হাজার চেষ্টা করেও সেই বিগ্রহের শেষ পাওয়া যায়নি বলে সেটি সরানো সম্ভব হয়নি।

বুড়োরাজের মন্দির।

বুড়োরাজের বিগ্রহ।

সে দিন রাতে যদু ঘোষ ফের এবং ওই গ্রামের এক ব্রাহ্মণ মধুসূদন চট্টোপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পান যে, সেই বিগ্রহটিকে ওই স্থান থেকে সরানো অসম্ভব। তাই সেখানেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু, গরিব সেই ব্রাহ্মণের পক্ষে নিত্যপুজোর ব্যয়ভার গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। তখন আবারও তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে প্রতি দিন তিন সের চাল আর দুধ দিয়ে পুজো করলেই হবে। সেই থেকে প্রতি দিন একটি থালায় তিন সের চালের নৈবেদ্য দিয়ে পুজো হয়। আর মাঝখানে একটা দাগ দেওয়া হয়। একাংশ শিবের উদ্দেশ্যে আর এর অংশ যম-ধর্মরাজের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। তবে, বিশেষ তিথিতে পরমান্ন ভোগ হয়। জামালপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, বিগ্রহটি বৌদ্ধ যুগের। মূলত অনার্য এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনেই নাকি বাংলায় ধর্মপুজোর প্রচলন ঘটেছিল।

তবে, হঠাৎ বুদ্ধ পূর্ণিমায় এই মেলা কেন? সত্যনারায়ণবাবু জানালেন, যে দিন সেই ব্রাহ্মণ স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন সে দিনটি ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা। তাই, প্রতি বছর সেই দিনটিতে এখানে বসে মেলা। বিশেষ পুজো-অর্চ্চনাও হয়।

তবে, বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে এত পশু বলি হয় কেন? এর উত্তরে এক সেবায়েৎ জানালেন, যম-ধর্মরাজের উদ্দেশ্যেই এই বলিদান। বিপদে পড়ে কিংবা কোনও গভীর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ দেবতার কাছে কিছু মানত করে। বিপন্মুক্ত হলে তাঁরা দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়। কেউ অন্য কিছু দান করে। তবে সময়ের সঙ্গে পশুবলি আগের তুলনায় কমেছে।

বাংলায় কী ভাবে শুরু হয়ে ছিল এই ধর্মরাজের পুজো?

এখানেই ইটের টুকরো বেঁধে মানত করেন ভক্তরা।

বাংলায় ধর্মপুজো প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘যখন সহজিয়া ধর্মের প্রাদুর্ভাবে বাঙালি একেবারে অকর্মণ্য ও নির্বীর্য হইয়া গিয়াছিল, ঠিক সেই সময় আফগানিস্থানের খিলজিরা আসিয়া উহাদের সমস্ত বিহার ভাঙিয়া দিল— দেবমূর্তি, বিশেষত যুগলাদ্য মূর্তি চূর্ণ করিয়া দিল— সহস্র সহস্র নেড়া ভিক্ষুর প্রাণনাশ করিল। ...মুসলমান বিজয়ে বৌদ্ধ-মন্দিরের ও বৌদ্ধ-দর্শনের একেবারে সর্বনাশ হইয়া গেল। ...বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাবকালে যাহারা অনাচরণীয় ছিল এবং মুসলমানাধিকারের পরে নতুন সমাজে যাহারা অনাচরণীয় হইল— বৌদ্ধধর্ম শেষে তাহাদের মধ্য নিবদ্ধ হইয়া পড়িল এবং তাঁহারা ক্রমে প্রজ্ঞা, উপায় ও বোধিসত্ত্ব ভুলিয়া গেল। শূন্যবাদ, বিজ্ঞানবাদ, করুণাবাদ ভুলিয়া গেল; দর্শন ভুলিয়া গেল। তখন রহিল জনকতক মূর্খ ভিক্ষু অথবা ভিক্ষু নামধারী বিবাহিত পুরহিত। তাহারা আপনার মতো করিয়া বৌদ্ধধর্ম গড়িয়া লইল। তাহারা কূর্মরূপী এক ধর্মঠাকুর বাহির করিল। এই যে কূর্মরূপ ইহা আর কিছু নহে, স্তূপের আকার। ...সুতরাং কূর্মরূপী ধর্ম আর স্তুপরূপী ধর্ম একই। পঞ্চবুদ্ধের প্রত্যেকের যেমন একটি করিয়া শক্তি ছিল। ধর্মঠাকুরেরও তেমন একটি শক্তি হইলেন, তাঁহার নাম কামিণ্যা। ...ধর্মঠাকুর আজও যে বাঁচিয়া আছেন, সে কেবল মানতের জোরে। নদীয়ার উত্তর জামালপুরের ধর্মঠাকুরের মন্দিরে বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে বারোশত পাঁঠা পড়ে।’

আজও বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে এখানে অসংখ্য পাঁঠা ও ভেড়া বলি হয়। মাঝেমধ্যেই বলির পাঁঠার ভাগ নিয়ে কিংবা কে আগে বলি দেবে তা নিয়ে মারামারিও বেধে যায় অস্ত্রধারীদের মধ্যে। হঠাৎই যেন ভেসে ওঠে আদিম সমাজের ছবি।

মেলায় বিকোচ্ছে ধামা-কুলো।

তবে, বাংলার অন্যান্য মেলায় অবক্ষয়ের ছবি দেখা গেলেও এখানে আজও দেখা যায় মেলার সাবেক ছবিটা। মেলা চলে মাসখানেক। স্থায়ী দোকানের পাশাপাশি অস্থায়ী দোকানও হয় এখানে। দোকানিরা আসেন কলকাতা, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, বর্ধমান, কাটোয়া, কালনা থেকে। বেতের ধামা, ঝুড়ি থেকে শুরু করে কাঠের বাসন, নতুন গ্রামের কাঠের পুতুল কিংবা পাথরের বাসন সবই মেলে। সময়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্ল্যাস্টিকের নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে ইমিটেশন জুয়েলারিও। এই সব নিয়েই জমজমাট মেলা। ভাবলে অবাক লাগে যে, মেলা চলাকালীন বহু দোকানি এখানে ঠিক মতো থাকার আশ্রয়টুকুও পান না। তবু কীসের টানে তাঁরা আসেন এখানে?

প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই মেলায় আসছেন কলকাতার শঙ্খ ও শাঁখা ব্যবসায়ী প্রদীপ সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু কেনা-বেচা বা অর্থ রোজগার নয়। এক বার কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েই এখানে যাতায়াত শুরু করি। সেই বিশ্বাস আজও অটুট।’’

এখানে কেউ আসেন ভক্তিতে, কেউ বা মেলার আকর্ষণে। ‘জয় বুড়োরাজের জয়’ ধ্বনি মুখরিত আকাশ বাতাস পরিবেশও যেন ভক্তদের মনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আজও সরল মানুষের বিশ্বাস বুড়োরাজের দরবারে এসে বোবার মুখে কথা ফোটে, দৃষ্টিহীন দৃষ্টি ফিরে পায়, দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হয় কিংবা নিঃসন্তান সন্তানসম্ভবা হয়। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ এই সময় সন্ন্যাস পালন করেন। কেউ ছুটে এসেছে পুরুলিয়া থেকে কেউ বা ভুবনেশ্বর থেকে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সরল ধর্মীয় বিশ্বাস আর লৌকিক কিংবদন্তির মাঝে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল জামালপুরের বুড়োরাজ।

গাড়িতে কলকাতা থেকে কল্যাণী রোড ধরে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু পেরিয়ে বাঁশবেড়িয়া হয়ে দিল্লি রোড ধরে সমুদ্রগড়, কালনা পেরিয়ে পৌঁছনো যায় বর্ধমান জেলার জামালপুরে। কিংবা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকালে পাটুলিতে নেমে ট্রেকারে বা ভ্যানে যাওয়া যায় জামালপুর।

jamalpur buddha purnima celebration buddha purnima with arms bibhuti sundar bhttacharya buroraj temple jamalpur buroraj temple
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy