Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

যেন যুদ্ধ চলছিল, গাঁয়ে ফিরে বললেন হালিমা

রক্ত ঝরার সাত দিন বাদে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত দিল মাখড়া। এক দিকে, মহরমের কারণে এলাকায় জারি থাকা ১৪৪ ধারা শিথিল করল বীরভূম জেলা পুলিশ-প্রশাসন। অন্য দিকে, তারই ফাঁক গলে সোমবার মাখড়া ও লাগোয়া চৌমণ্ডলপুর গ্রামে ত্রাণ নিয়ে ঢুকল বিজেপির প্রতিনিধি দল। গ্রামবাসীদের একাংশ যেমন বিজেপির মিছিলে সামিল হলেন, তেমনই যোগ দিলেন নিত্য দিনের কাজে।

ঘটনার পরে ১৪৪ ধারা শিথিল হতেই ছন্দে ফিরছে মাখড়া ও চৌমণ্ডলপুর। টিফিনে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে পড়ুয়ারা।

ঘটনার পরে ১৪৪ ধারা শিথিল হতেই ছন্দে ফিরছে মাখড়া ও চৌমণ্ডলপুর। টিফিনে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে পড়ুয়ারা।

মহেন্দ্র জেনা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০৫
Share: Save:

রক্ত ঝরার সাত দিন বাদে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত দিল মাখড়া।

এক দিকে, মহরমের কারণে এলাকায় জারি থাকা ১৪৪ ধারা শিথিল করল বীরভূম জেলা পুলিশ-প্রশাসন। অন্য দিকে, তারই ফাঁক গলে সোমবার মাখড়া ও লাগোয়া চৌমণ্ডলপুর গ্রামে ত্রাণ নিয়ে ঢুকল বিজেপির প্রতিনিধি দল। গ্রামবাসীদের একাংশ যেমন বিজেপির মিছিলে সামিল হলেন, তেমনই যোগ দিলেন নিত্য দিনের কাজে। এক সপ্তাহ পরে ক্লাসঘরে দেখা গেল এলাকার স্কুলপড়ুয়াদেরও। তবে, এ দিনই আবার সন্ধে নাগাদ কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দলকে এলাকায় ঢুকতে দিল না পুলিশ-প্রশাসন। দিনের শেষে তা নিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠল পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও।

বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “মহরম উপলক্ষে ওই এলাকায় শর্ত সাপেক্ষে সাময়িক ভাবে ১৪৪ ধারা শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু, এলাকায় কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি করা যাবে না।” তা হলে বিজেপি ওই দুই গ্রামে কী করছিল? জেলাশাসকের বক্তব্য, “এ দিন এই নির্দেশ জারি হওয়ার পরে সম্ভবত কোথাও একটা সমন্বয়ের অভাব হয়েছিল। তাই একটি রাজনৈতিক দল ওই দুই গ্রামে ঢুকে পড়েছিল।”

গত ২৪ অক্টোবর চৌমণ্ডলপুরে বোমা উদ্ধারে গিয়ে আক্রান্ত হন পাড়ুই থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত। তার পর থেকেই মাখড়া, চৌমণ্ডলপুর-সহ লাগোয়া অঞ্চলে ১৪৪ ধারা জারি করে। তারই মধ্যে গত সোমবার মাখড়ায় বিজেপি-তৃণমূল বোমা-গুলির সংঘর্ষে নিহত হন তিন জন। পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে। গত সাত দিন বিজেপি, কংগ্রেস এবং বামেদের প্রতিনিধিদলকে একাধিক বার ১৪৪ ধারা জারি থাকার যুক্তিতে মাখড়া, চৌমণ্ডলপুরে ঢোকা থেকে আটকে দিয়েছে পুলিশ।

এ দিনই প্রথম ওই ধারা সাময়িক শিথিল করা হল। এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ প্রথমে বিজেপির মহিলা মোর্চার নেতৃত্বে শতাধিক কর্মী-সমর্থক স্থানীয় ব্রাহ্মণডিহির কাছে মিছিল বের করে ওই দুই গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। মিছিল রাঘাইপুর হাইমাদ্রাসার কাছে পৌঁছতেই পুলিশ তা আটকে দেয়। তাঁরা রাস্তাতেই বসে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। বিক্ষোভ চলাকালীনই জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায় এবং এসডিপিও (বোলপুর) সূর্যপ্রতাপ যাদব সাড়ে ১২টা নাগাদ ব্যারিকেড খুলে দেন। বিজেপির মহিলা কর্মীরা চৌমণ্ডলপুরে ঢোকার পরে দুপুর ১টা নাগাদ বিজেপির আরও একটি দল চৌমণ্ডলপুরে পৌঁছয়। মোটরবাইকে চেপে আসেন বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল এবং জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৪ তারিখের ঘটনার পরে এই প্রথম ওই গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে বিজেপি নেতাদের কাছে তাঁদের দুর্দশার কথা জানাতে শুরু করেন। স্থানীয় মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের সদস্য আঞ্জু মানোয়ারা বিবি বলেন, “পুলিশ গ্রামের পাঁচ নিরপরাধ মহিলার নামে কেস দিয়েছে। এ ব্যাপারে আপনারা কিছু করুন।”

গাঁয়ে ঢুকেছে ফেরিওয়ালা। শুরু হয়েছে শীতের পোশাকের বিক্রিবাটাও।

১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের খবর পেয়ে এ দিনই চৌমণ্ডলপুরে ফিরেছেন গ্রামছাড়া ইশমোতারা বিবি। বাড়ির ছেলেরা অবশ্য এখনও ফেরার সাহস পাননি। বাড়ি ফেরা শুরু হয়েছে মাখড়াতেও। সাত দিনের মাথায় কা্যানাল পাড়ে নিজের চায়ের দোকান খুলেছেন শেখ আকাশ। বেলা যত এগিয়েছে ভয় ভেঙে একে একে ভিড় জমিয়েছেন তাঁর বাঁধা খদ্দেররা। সেখানেই চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন স্থানীয় ইখুসাড়া গ্রামের করিম খান। ইলামবাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাখড়ার কাছে তাঁর মোটরবাইকের চাকা লিক হয়ে যায়। করিম বললেন, “ভাগ্যিস আব্দুল ভাইয়ের চাকা সারাইয়ের দোকানটা আজ খুলেছে। কী করে বাড়ি ফিরতাম, ভাবুন!” গত সোমবার হামলার সময় হালিমা বিবির পায়ের কাছে এসে পড়েছিল দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমা। তার পরই মাখড়া ছেড়ে ঘুড়িষায় বাপের বাড়িতেই পড়েছিলেন আতঙ্কিত ওই মহিলা। এ দিন গ্রামে ফিরে অন্তঃসত্ত্বা হালিমা বললেন, “এত দিন মনে হচ্ছিল গাঁয়ে যেন যুদ্ধ লেগেছে! মহরমের আগে ফিরতে পেরে খুব ভাল লাগছে।” ছন্দে ফিরছে পুলিশ ক্যাম্প থাকা মাখড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। ঘটনার পর এই প্রথম সেখানে ক্লাস করেছে গ্রামের ৩১ জন পড়ুয়া।

দুধকুমাররা মাখড়ায় ঢোকার আগেই এ দিন বিজেপির ঝান্ডা নিয়ে মিছিল করে গ্রাম থেকে তাঁদের স্বাগত জানাতে বেরিয়েছিলেন বহু বাসিন্দা। গ্রামে আরও বড় মিছিল বেরোয়। স্লোগান ওঠে, “তৃণমূল সরকার, আর নেই দরকার।” পরে বিজেপি নেতারা নিহত দলীয় সমর্থক শেখ তৌসিফ আলির বাড়িতে যান। নিহতের বৃদ্ধ বাবা শেখ সওকত আলি ছেলের খুনিদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানান। পরিবারটিকে আশ্বস্ত করে গ্রামের ক্যানাল লাগোয়া রাস্তায় পথসভা করে বিজেপি। সেখানে দুধকুমার বাসিন্দাদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা কোনও রকম প্ররোচনায় পা দেবেন না। সকলকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিতে থাকুন। আমরা আপনাদের পাশে আছি।”

নিহত শেখ তৌসিফ আলির বাবার সঙ্গে কথা বলছেন বিজেপি নেতা

জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। রয়েছেন বিজেপি-র জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলও।

বেলা ৩টে নাগাদ বিজেপি নেতারা বেরিয়ে যাওয়ার পরে বিকেল সাড়ে ৪টেতে কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির নেতৃত্বে কয়েকশো কর্মী-সমর্থক এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করলে চৌমণ্ডলপুরের আগেই পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়। কংগ্রেস রাস্তাতেই অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করে। পরে তারা ব্যারিকেড ভেঙে এগোনোর চেষ্টা করতেই সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ জিম্মি-সহ ২৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ পাড়ুই থানায় নিয়ে যায়। রাতে তাঁরা ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া পান। জিম্মির অভিযোগ, “১৪৪ ধারা প্রত্যাহার হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ আমাদের বেআইনি ভাবে গ্রেফতার করেছে। অথচ ওরা বিজেপি-কে ঢুকতে দিল। এটা পক্ষপাত নয়তো কী?”

যদিও এই সব রাজনৈতিক চাপানউতোর পাশ কাটিয়েই স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার মরিয়া চেষ্টায় মাখড়া। গ্রামের দক্ষিণপাড়ার তরুণী তকলিমা খাতুন ঠিক করেছেন, আজ থেকে ফের ইলামবাজার কলেজে গিয়ে ক্লাস করা শুরু করবেন।

সোমবার ছবি তুলেছেন বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE