Advertisement
১৯ মে ২০২৪
ফকিরচাঁদ কলেজ

দফায় দফায় তাণ্ডবে আতঙ্কিত পড়ুয়া

এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে কলেজে ঢুকে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সোমবারও ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে ঢুকে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক দীপক হালদার গোলমালে জড়িয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘ওঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’

পুলিশের সামনেই চলছে মারপিট। নিজস্ব চিত্র।

পুলিশের সামনেই চলছে মারপিট। নিজস্ব চিত্র।

শান্তশ্রী মজুমদার
ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:১০
Share: Save:

এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে কলেজে ঢুকে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সোমবারও ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে ঢুকে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক দীপক হালদার গোলমালে জড়িয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘ওঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাঙ্গণে বহু ঘটনায় তৃণমূলের ‘দাদাগিরি’র সাক্ষী থেকেছে রাজ্য। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নিজেদের মধ্যেও গোলমালের ঘটনায় একাধিক বার রক্ত ঝরেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যাকে স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী ‘ছোট ছেলেদের কাণ্ড’ বলে লঘু করে দেখাতে চেয়েছেন। যা নিয়েও রাজ্য জুড়ে সমালোচনার ঝড় কম ওঠেনি। সোমবার অবশ্য ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজের ঘটনায় পুলিশকে দ্রুত এবং ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে। কলেজে ঢুকে গোলমাল পাকানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন বিধায়ক দীপক হালদার। তবে পুলিশের ‘অতি সক্রিয়তার’ পিছনে দলের কোনও গোষ্ঠীর চাপ ছিল কিনা, সে প্রশ্নও উঠছে।
দীপকবাবু নিজেও মনে করছেন তিনি চক্রান্তের শিকার। গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাকে যাতে ভোটের টিকিট না দেওয়া হয়, তার চেষ্টাই করছে ওরা। এই কাজে পুলিশকেও ব্যবহার করা হচ্ছে।’’ তবে কার বিরুদ্ধে ইঙ্গিত করছেন তিনি, তা নিয়ে মন্তব্য করেননি বিধায়ক। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘কলেজে মারপিট হয়েছে বলে খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো কাউকে মারধর করতে যাইনি। বরং সংঘর্ষ থামাতে গিয়েছিলাম।’’
কী হয়েছিল এ দিন?
সোমবার বেলা পৌনে ২টো নাগাদ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে ঢোকেন দীপকবাবু। মারমুখী বিধায়ককে সামলাতে হিমসিম খেতে হয় পুলিশকে। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা ততক্ষণে কলেজের নানা প্রান্তে গিয়ে তাণ্ডব শুরু করেছে। মারধর করা হয় অনেককে। প্রহৃতরাও সকলে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী-সমর্থক বলে জানা গিয়েছে। ঘণ্টা দু’য়েকেরও বেশি সময় ধরে দীপকবাবু ও তাঁর অনুগামীদের কলেজে দেখা গিয়েছে। পুলিশের সামনেই চলেছে মারপিট।
কিন্তু কেন এমন রণংদেহি মূর্তি ধরলেন বিধায়ক?
এর পিছনে তৃণমূলের পুরনো গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই দায়ী। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কলেজে ছাত্র সংসদ গড়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। সংসদের ক্ষমতায় বিধায়ক গোষ্ঠীর লোকজন। যা বরাবরই না-পসন্দ দীপকবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতাদের। ওই গোষ্ঠীতে আছেন তৃণমূলের ডায়মন্ড হারবার ১ ব্লক সভাপতি উমাপদ পুরকাইত ডায়মন্ড হারবার ১ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মনোমোহিনী বিশ্বাস, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেবকী হালদার প্রমুখ। এর আগেও একাধিক বার কলেজে দুই গোষ্ঠীর অনুগামীদের মধ্যে হাতাহাতি, মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। মাস খানেকের মধ্যেও বার তিনেক হাতাহাতি বেধেছে দু’পক্ষের। রবিবার সন্ধ্যাতেও কলেজের বাইরে স্টেশন চত্বরে দু’পক্ষের মধ্যে বচসা, ধস্তাধস্তি বাধে বলে অভিযোগ।

যার প্রতিবাদে এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ কলেজে চড়াও হয় তৃণমূলের শ’খানেক কর্মী-সমর্থক। অভিযোগ, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মনোমোহিনীদেবী ও দেবকীদেবী। মনোমোহিনীদেবী অবশ্য কলেজে ঢোকেননি বলেই সূত্রের খবর। বহিরাগতদের হাতে লাঠিসোঁটা, ভোজালি ছিল জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ইউনিয়ন রুমে ঢুকে শৌভিক দে, বিদেশ হালদার, সৌমেন দণ্ডপাট, তরুণ হালদারদের বেধড়ক মারধর করা হয়। এঁরা সকলেই কলেজের ছাত্র। সৌমেন কলেজ সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। সকলেই দীপকবাবুর ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত। কলেজ সূত্রের খবর, বহিরাগত হামলাকারীরা এ দিন ক্লাসে ঢুকে ঢুকে অনেকের নাম করে খুঁজছিল। সকলেই বিধায়ক-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর। ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সম্পাদক অমিত সাহা, কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বিকাশ টুডুদের নাম করেও খোঁজাখুঁজি করে উন্মত্ত তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। বিকাশ, অমিতের মতো বিধায়ক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কিছু বহিরাগত যুবকই নানা কৌশলে ছাত্র সংসদের উপরে ছড়ি ঘোরান বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। অমিতরা অবশ্য সে সময়ে কলেজে ছিলেন না।

প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে কলেজে তাণ্ডব চালায় বহিরাগতরা। ভাঙচুর চলে ইউনিয়ন রুম, ক্যান্টিনে। সাধারণ ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকদের গায়ে কেউ হাত তোলেনি ঠিকই, তবে জনতার রুদ্রমূর্তি দেখে সকলে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন।

তৃণমূলনেত্রী মনমোহিনী বিশ্বাস অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘ঝামেলার কথা শুনে এলাকায় গেলেও কলেজে ঢোকেননি। কাউকে কোনও মদতও দেননি। তাঁর সম্পর্কে কুৎসা রটানো হচ্ছে। দেবকী হালদারের বক্তব্য: ‘‘এ দিন যখন শুনি আমার ওয়ার্ডের লোকজন কলেজে ঢুকে ঝামেলা করছে, তখন তাঁদের কলেজ থেকে বের করে এনেছি। কোনও ঝামেলা-মারপিট করিনি।’’

অধ্যক্ষ সুবীরেশ ভট্টাচার্য কলেজে আসেননি এ দিন। টেলিফোনে খবর পেয়ে তিনি পুলিশ ডাকেন। ১টা নাগাদ এসে পড়ে পুলিশ। ততক্ষণে অবশ্য পিছনের গেট দিয়ে কলেজ ছেড়ে চলে গিয়েছে বহিরাগতেরা। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কলেজ থেকে বের করে দেওয়া শুরু করে পুলিশ।

কলেজে সংঘর্ষে জখম এক ছাত্র।

এ দিকে, পুলিশ আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মোটর বাইকে চেপে কলেজে চলে আসেন বিধায়ক দীপকবাবু। সঙ্গে লাঠিসোঁটা নিয়ে চলে আসে আরও বেশ কিছু ছেলে। তাদের মধ্যে অমিত-বিকাশও ছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

দীপকবাবু কলেজে ঢুকেই চিৎকার-চেঁচামিচি শুরু করেন। পুলিশ কেন সময় মতো ব্যবস্থা নেয়নি, কেন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মারধর করল বহিরাগতরা, এই প্রশ্ন তুলে বিধায়ক পুলিশের দিকে উত্তেজিত ভাবে তেড়ে যান। দীপকবাবুর দাবি, পুলিশের সামনেই মারধর করা হয়েছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখেছে। পুলিশ, র‌্যাফ, কমব্যাট ফোর্স মিলিয়ে তখন কলেজে হাতে গোনা জনা তিরিশ ছিলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে। তাঁরা রীতিমতো হিমসিম খান বিধায়কের চোটপাট সামলাতে।

ততক্ষণে বিধায়কের অনুগামীরা ছড়িয়ে পড়েছে কলেজের নানা প্রান্তে। বিধায়কের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে খুঁজে পেটানো হয়। সে সময়ে জখম হন মালা মণ্ডল, বর্ণালী চক্রবর্তী। তাঁরা ছাত্র সংসদের সদস্য এবং উমাপদবাবুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। দু’পক্ষের ৬ জনকে পরে ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় ঘণ্টা আড়াই পরে বিকেল সাড়ে ৪টের দিকে সদলবলে কলেজ ছাড়েন বিধায়ক। কাছেই নাইয়াপাড়া। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময়ে এলাকার কিছু লোকজন তাঁদের তাড়া করে। এরাও বিধায়কের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকজন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। পুলিশই বিধায়কের বাইকের পিছু পিছু নিরাপদে এলাকা থেকে বের করে দেয় সকলকে।

কলেজের ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক অমিত সাহা বলেন, ‘‘আমি এখন কলেজে ঢোকা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু প্রথমে উমাপদ পুরকাইত, মনমোহিনী বিশ্বাসের লোকজন আমাদের ছেলেদের মাধধর করে বলে সকলের সামনে গিয়েছি। কোনও অন্যায় করিনি।’’ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌম্য নস্কর বলেন, ‘‘কলেজের ইউনিয়নে বাইরের ছেলেরা এসে নাক গলাচ্ছে, এই অভিযোগ মিথ্যা।’’

বিকেলের দিকে হাসপাতালে তাঁর অনুগামীদের দেখতে হাজির হন বিধায়ক। ইতিমধ্যে পুলিশ কর্তাদের কাছে ফোন আসে। আইসি ডায়মন্ড হারবার বিশ্বজিৎ পাত্র দীপকবাবুকে জানান, থানায় যেতে হবে। তাঁকে গ্রেফতার করার নির্দেশ এসেছে ‘উপর’ থেকে। ততক্ষণে বিধায়কের ফোনেও দলের এক শীর্ষ নেতার বার্তা এসেছে বলে দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে। তাঁকে যে গ্রেফতার করা হবে, তার আঁচে পেয়েই গিয়েছিলেন দীপকবাবু।

তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ যখন, আমি অবশ্যই তা পালন করব।’’ বিধায়ককে গাড়িতে তুলে পুলিশ হাসপাতালের বাইরে আসার সময়ে দীপকবাবুর বেশ কিছু অনুগামী গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। বিধায়ক তাঁদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজেই পুলিশের কাজ সহজ করে দেন। বিধায়ককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে পরে কিছু জায়গায় পথ অবরোধও করেন তাঁর অনুগামীরা। থানার সামনেও ধর্নায় বসেন অনেকে।

কলেজের সাধারণ সম্পাদক সৌম নস্করের অভিযোগের ভিত্তিতে আনোয়ার হুসেন মীর (দ্বিতীয় বর্ষের) ফারুখ ঘরামি (প্রথম বর্ষের) গ্রেফতার করেছে। এই অভিযোগে মনমোহিনী বিশ্বাস এবং দেবকী হালদারেরও নাম রয়েছে।

দীপকবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা বলে পরিচিত উমাপদ পুরকাইত বলেন, ‘‘কলেজে ঝামেলার কথা শুনেছি। আমার বিরুদ্ধে বিধায়কের আনা অভিযোগ মিথ্যা। তিনি দলের প্রবীণ নেতাদের সম্মান দেন না। তা ছাড়া, কলেজের বিষয়ে আমি যে নাক গলাই না, তা সকলেই জানে। সকলে এটাও জানে, দীপকবাবু কী ভাবে চলছেন। দল সবই দেখছে, মানুষও দেখছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Violence Fakir Chand college Ashok Rudra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE