রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের (এজি) পদ থেকে মঙ্গলবার ইস্তফা দিলেন প্রবীণ আইনজীবী জয়ন্ত মিত্র। একই সঙ্গে ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন অতিরিক্ত এজি লক্ষ্ণী গুপ্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমানায় গত ছ’বছরে এই নিয়ে এজি-র পদ ছাড়লেন তিন জন বিশিষ্ট আইনজীবী!
কেন এই পদত্যাগ?
এ দিন বিকেল পৌনে তিনটে নাগাদ রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জয়ন্তবাবু বলেন, ‘‘সরকারের সঙ্গে মতান্তর ক্রমে বাড়ছিল। বেশ কিছু বিষয়ে আমার পরামর্শও মানা হচ্ছিল না। বরং সরকার জানিয়ে দিচ্ছিল, আমার পরামর্শ গ্রহণযোগ্য নয়। জীবন ও পেশার এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি যেখানে এ সব আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই নিজেই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘চিরকাল শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলেছি। যা ঠিক নয়, তার কাছে নত হতে শিখিনি।’’
পদত্যাগ করার আগে এ দিন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক এবং শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন জয়ন্তবাবু। তবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেননি। সে প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে জয়ন্তবাবুর মন্তব্য, ‘‘উনি তো সবই জানতেন।’’
নবান্ন সূত্রের খবর, জয়ন্তবাবুর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক যে স্তরে পৌঁছেছিল তাতে এটা ভবিতব্যই ছিল। গত মাসখানেক ধরে ঘনিষ্ঠ মহলে জয়ন্তবাবু পদত্যাগ করার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, তাঁর সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, তাতে মানসম্মান নিয়ে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এজি-র ঘনিষ্ঠ সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, রাজ্য সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্তে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল যে তা নিয়ে মামলায় যুক্তি সাজাতে গিয়ে থই পাচ্ছিলেন না জয়ন্তবাবু। যেমন, বিধাননগরে উপ-নির্বাচন নিয়ে মামলা, গত দুর্গাপুজোয় বিসর্জনের নির্ঘণ্ট নিয়ে মামলা, নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে জনস্বার্থ মামলা অথবা হালে ব্রিগেডে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সভাকে কেন্দ্র করে মামলায় রাজ্যকে ‘রক্ষা’ করতে গিয়ে বারবার বেকায়দায় পড়েন তিনি। পাশাপাশি, তাঁর বদলে তৃণমূলের এক আইনজীবী সাংসদের মতকে নবান্ন বেশি গুরুত্ব দেওয়াতেও ক্ষুণ্ণ হন জয়ন্তবাবু।
এজি-র বিরুদ্ধে অবশ্য পাল্টা অভিযোগ করেছেন আমলাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, একে তো ওঁর আইনি পরামর্শ মেনে চলে সুবিধা হচ্ছিল না রাজ্যের। আরও অসুবিধার বিষয় ছিল, উনি নবান্নে এসে আমলা-মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করতে রাজি হতেন না। এক বার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র তাঁকে নবান্নে ডেকে পাঠালেও তিনি উপস্থিত হননি। আইন দফতরের এক কর্তা জানান, মঙ্গলবার সকালেই জয়ন্তবাবু ও লক্ষ্মীবাবুকে ইস্তফা দিতে বলা হয়। লক্ষ্ণীবাবু অবশ্য এ দিন বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে সরকারের কোনও মতপার্থক্য হয়নি। বরং রাজ্য আমার সুপারিশ মেনেছে। কিন্তু জয়ন্তবাবুর নেতৃত্বে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতাম। সেই দলটাই যখন ভেঙে গেল, আমিও সরে দাঁড়াব।’’
এজি-র সঙ্গে কোন কোন বিষয়ে সরকারের মতান্তর ছিল, নবান্ন সূত্রে তার ধারণাও মিলেছে এ দিন। যেমন, ৭০০-এর বেশি কর্মীকে সরাসরি নিয়োগের ব্যাপারে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষা দফতর। জয়ন্তবাবুর মত ছিল, লিখিত পরীক্ষা ও ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে নিয়োগ হোক। কারণ, অতীতে সিভিক পুলিশ নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে রাজ্যকে তুলোধোনা করেছিল হাইকোর্ট। আবার উত্তরবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নিয়োগ নিয়েও নবান্নের সঙ্গে মতান্তর হয় জয়ন্তবাবুর। এজি-র বক্তব্য ছিল, যাঁকে রেজিস্ট্রার করার কথা ভেবেছে নবান্ন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। তাঁকে নিয়োগ করা ঠিক হবে না। কিন্তু তাঁর পরামর্শ মানেনি রাজ্য। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা জানান, গত ৩১ জানুয়ারি যে পদ্ধতিতে ২০১৫ সালের প্রাথমিক টেটের ফলপ্রকাশ করা হয়, তা নিয়েও নবান্নের সঙ্গে এজি-র মতবিরোধ হয়েছিল। ওই পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন জয়ন্তবাবু। তা যে অনেকটাই সত্য এ দিনই তার প্রমাণ মিলেছে। এ দিন রাজ্যের সাতটি জেলার ১৫০ জন টেট উত্তীর্ণ হাইকোর্টে বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদালতে মামলা করেছেন। আগামিকাল, বৃহস্পতিবার তার শুনানি ধার্য হয়েছে।
জয়ন্তবাবুর ইস্তফার খবর ছড়াতেই সরব হন বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান এবং বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বিধানসভায় আইনমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন। পরে তাঁরা বলেন, ছ’বছরে তিন জন এজি ইস্তফা দেওয়াতেই পরিষ্কার যে রাজ্যে আইনের শাসন নেই। রাজ্য সরকার এত ভুল পদক্ষেপ করছে যে আদালতে সরকারকে বাঁচাতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ছেন এজি-ও।
তৃণমূলের আমলে এর আগে এজি-র পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন অনিন্দ্য মিত্র ও বিমল চট্টোপাধ্যায়। আইনজীবী মহলের খবর, সরকারের সঙ্গে মতের অমিলের কারণেই তাঁরা ইস্তফা দিয়েছিলেন। ৫০তম এজি হিসাবে ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর জয়ন্তবাবুকে নিয়োগ করেন রাজ্যপাল। দু’বছর পেরোতেই আবার বদল!
সরকারি সূত্রের খবর, হাইকোর্টের আইনজীবী কিশোর দত্তকে নতুন এজি নিযুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার। হাইকোর্টের আইনজীবী শাশ্বতগোপাল মুখোপাধ্যায়কে পাবলিক প্রসিকিউটির (পিপি) করার কথাও ভাবা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy