Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দিল্লির ‘কাঁটা’ তুলতে ঝুঁকির পথই নিলেন মমতা

খবরটা খুব সকালে পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর কাছে। পুলিশ-প্রশাসন মারফত তিনি জেনে গিয়েছিলেন, আজ ভোরে ফের ধস নেমেছে। কালিম্পংয়ের উনত্রিশ মাইল, মিরিকের পথে গেয়াবাড়ি প্রভৃতি জায়গায় রাস্তা বন্ধ। কিন্তু, আজই তাঁর ধস-বিধ্বস্ত এলাকাগুলি দেখতে যাওয়ার কর্মসূচি। তিনি যাবেন দুর্গতদের পাশে অর্থ ও ত্রাণ সাহায্য নিয়ে।

গেয়াবাড়ির এ পথেই মিরিক যাওয়ার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। ধসে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দার্জিলিং ঘুরে যেতে বাধ্য হন তিনি। ছবি: রবিন রাই।

গেয়াবাড়ির এ পথেই মিরিক যাওয়ার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। ধসে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দার্জিলিং ঘুরে যেতে বাধ্য হন তিনি। ছবি: রবিন রাই।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
মিরিক শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৬
Share: Save:

খবরটা খুব সকালে পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর কাছে। পুলিশ-প্রশাসন মারফত তিনি জেনে গিয়েছিলেন, আজ ভোরে ফের ধস নেমেছে। কালিম্পংয়ের উনত্রিশ মাইল, মিরিকের পথে গেয়াবাড়ি প্রভৃতি জায়গায় রাস্তা বন্ধ। কিন্তু, আজই তাঁর ধস-বিধ্বস্ত এলাকাগুলি দেখতে যাওয়ার কর্মসূচি। তিনি যাবেন দুর্গতদের পাশে অর্থ ও ত্রাণ সাহায্য নিয়ে।

অতএব, যেতে তাঁকে হবেই। তিনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতটাই নাছোড়। পুলিশ-প্রশাসন-আমলা-অফিসার, এ ব্যাপারে কারও কোনও পরামর্শ তিনি শুনতে নারাজ।

দিল্লি থেকে বিশেষ বিমানে উড়ে এসে গত কাল মাঝরাতেই মিরিকে চলে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। বহরমপুরে সরকারি কর্মসূচি সেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন সুকনায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অবশ্য মিরিকের দুর্গত অঞ্চলে উঁকি দিয়ে রাতে থাকতে চলে যান দার্জিলিঙের পাহাড়ে। সেখানেই লেবং হেলিপ্যাড থেকে আজ সকালে উড়ে আসেন কালিম্পংয়ে। কথা ছিল, কালিম্পঙের পরিস্থিতি দেখে ফের হেলিকপ্টারেই বাগডোগরা এসে দিল্লি ফিরে যাবেন তিনি। কিন্তু, বাদ সাধে আবহাওয়া। তাই কালিম্পং থেকে ঘুরপথে ঘুম হয়ে রিজিজুকে বাগডোগরায় নামতে হয়। তাঁর এই পথপরিক্রমা তাই কার্যত পরিস্থিতির চাপে।

মমতা অবশ্য পথের সেই চাপ নেন সচেতন ভাবেই। যখন তিনি শোনেন গেয়াবাড়ি হয়ে মিরিকে যাওয়ার রাস্তা অগম্য, তখনই তাঁর সিদ্ধান্ত, কার্সিয়াং ছুঁয়ে, ঘুম হয়ে উপর থেকে নীচে মিরিকে দুর্গতদের কাছে পৌঁছবেন তিনি। তাতে দু’ঘণ্টার পথ পেরোতে পাঁচ ঘণ্টা লাগলেও কুছ পরোয়া নেই।

সঙ্গী দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও গৌতম দেব, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি-সহ জেলা প্রশাসনের এক ঝাঁক অফিসার। দিল্লি গত কাল রাতেই যে ভাবে তড়িঘড়ি বিশেষ বিমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে পাঠিয়েছে সরেজমিন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে (স্টক টেকিং), তাতে রাজ্য প্রশাসনের অন্দরে উষ্মা গোপন ছিল না। মন্ত্রীর সঙ্গী হয়ে দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়ার উপস্থিতি এবং বিমল গুরুঙ্গদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা তাতে ঘৃতাহুতি দেয়।

সাধারণত, এই ধরনের যে কোনও দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মমতার ছুটে যাওয়া কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু, গত কাল থেকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের তরফে তৎপরতা দেখার পরেই আজ যে কোনও মূল্যে বিধ্বস্ত এলাকার মানুষের পাশে গিয়ে সশরীরে দাঁড়ানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও ছিল একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তিনি তাঁর ‘সদ্ব্যবহার’ করেছেন।

রোহিণীর নতুন সড়ক থেকে কার্শিয়াং পৌঁছে ঘুমের দিকে যত এগিয়েছে তাঁর কনভয়, ততই বেড়েছে ঝুঁকির বহর। এক সময় দেখা যায়, ঘন অন্ধকার হয়ে যাওয়া পাহাড়ি পথে প্রবল যানজটে (উপর থেকে নেমে আসছে ঝাঁক ঝাঁক গাড়ি) মুখ্যমন্ত্রীর গাড়িটি একেবারে খাদের কিনারা ঘেঁষে চলছে। বৃষ্টিভেজা মাটি সেখানেও যথেষ্ট আলগা। কোথাও কোথাও মাটি ও পাথরের ছোট-বড় চাঁই নেমে এসেছে প্রায় গাড়ির চাকা বরাবর।

এই অবস্থায় এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কি উচিত? না হয় না-ই বা গেলেন আজ! মমতা সেই সব নস্যাৎ করে জানিয়ে দেন, যদি পথে মৃত্যুও হয় তিনি ফিরবেন না।

ঘুম থেকে মিরিকের পথ বেয়ে নামতে নামতে প্রথমেই সুকিয়াপোখরিতে মাটির গর্ভে চলে যাওয়া বাড়িটির জেগে থাকা ছাদ নজরে পড়ল তাঁর। সেখানে মৃত্যু হয়েছে মঞ্জিল তামাঙ্গের। অফিসারেরা জানালেন, পাশেই একটি আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মৃতের স্ত্রীকে। বাড়িতে ছিলেন না বলেই তিনি তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন।

মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁর হাতে চার লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দিচ্ছেন, দুর্ঘটনার ঘোরে থাকা ওই মহিলা তখনও অঝোরে কেঁদে চলেছেন।

আবার এগিয়ে চলা। সইরানি বাজারে দুর্গত শিবির ঘুরে মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় পৌঁছল টিংলিং। ধসে এ পর্যন্ত যে ৩০ জনের মৃত্যু সংবাদ মিলেছে তার ২৩ জনই এই এলাকার। উপর থেকে মমতা দেখলেন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধসে গুঁড়িয়ে যাওয়া বাড়িগুলির ধ্বংসস্তূপ। তাঁকে জানানো হল, দু’টি বাড়িতেই মৃতের সংখ্যা ১৯। টিংলিং চা বাগানের ভিতর আশ্রয় শিবিরে ১০৪টি পরিবার রয়েছে। তাঁরা সবাই যে আর্থিক ভাবে খুব দুর্বল তা হয়তো নয়। কিন্তু, রাতের অন্ধকারে হঠাৎ তাণ্ডব তাঁদের গৃহহীন, নিঃস্ব করে দিয়েছে। মৃতদের জন্য মাথাপিছু হিসাবে তাঁদের প্রত্যেকের পরিবার চার লক্ষ টাকা করে সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন। যে পরিবারের তিন জন নেই সেই পরিবার পাচ্ছে ১২ লাখ। আহতদের মাথাপিছু সাহায্য এক লক্ষ ২৫ হাজার টাকা।

দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের হাতে ত্রাণ সাহায্য তুলে দিয়ে এ বার ‘তুরুপের তাস’টি নিখুঁত ভাবে খেললেন মমতা। বললেন, ‘‘স্টক টেকিং করার জন্য দুমদাম এসে এক ঝলক ঘুরে গেলেই হয় না। মাটির উপর দিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, পরিস্থিতির আঁচ পেতে পেতে আসতে হয়। তাতে হয়তো সময় বেশি লাগে। কিন্তু সেটাই করা উচিত বলে আমি মনে করি।’’ সেই সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করতে আরও একটু সময় লাগবে। মুখ্যসচিব সব কিছু পর্যালোচনা করে কেন্দ্রের কাছে যথাসময়ে সেই রিপোর্ট পাঠাবেন।

না, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী রিজিজু-র নাম মুখেই আনেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কাঁটার খোঁচা তিনিই বোঝেন যাঁর পায়ে সেই কাঁটা ফোটে!

ফেরার সময় গয়াবাড়ির ভেঙে যাওয়া সড়কই বেছে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাস্তার উপর দীর্ঘ ফাটল, যেমনটি ভূমিকম্পে হয়। তার এক দিকে গাড়ি রেখে সন্তর্পণে হেঁটে অন্য গাড়িতে ওঠেন তিনি। ফলে ফেরার পথে সময় অনেকটা কম লাগল। তবে, ঝুঁকিপূর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে পৌঁছনোর বার্তা তত ক্ষণে মমতার দেওয়া হয়ে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE