এমনিতেই বাংলার ভাঁড়ার ঠনঠনে। তার উপরে নোট বাতিল নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া থাকায় ক্ষতিপূরণের কেন্দ্রীয় নির্দেশ ঘিরে শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন তরজা।
১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করিয়ে নিলেও শ্রমিকদের মজুরি বাবদ প্রায় ১১০০ কোটি টাকা দিতে পারেনি রাজ্য। সময়মতো মজুরি না-দেওয়ায় ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যকে আরও ৩৪৩ কোটি টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। নবান্নের খবর, দিল্লির এই নির্দেশ যখন পৌঁছয়, সেই সময় রাজ্যের হাতে ছিল মাত্র ১৪০ কোটি। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ফের সুর চড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পঞ্চায়েত দফতর।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সোমবার বলেন, ‘‘এরা সব সীমা ছাড়াচ্ছে। কেন্দ্র সময়মতো টাকা দেয়নি বলে আমরাও মজুরি দিতে পারিনি। অথচ এই দেরির জন্য আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলে শ্রমিক খেপানোর চেষ্টা করছে ওরা।’’
সরকার কি ক্ষতিপূরণ দেবে না?
‘‘আইন অনুযায়ী সেটা বলব না। তবে রাজ্যের হাতে কোনও টাকা নেই। কেন্দ্র যে-ভাবে এখনই বকেয়া মজুরি এবং ক্ষতিপূরণ মেটাতে বলছে, সেটা সম্ভব নয়,’’ জবাব সুব্রতবাবুর।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী হাত ধুয়ে ফেললেও তাঁর দফতরের কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারণ, ১০০ দিনের কাজে সময়মতো মজুরি মেটাতে না-পেরে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে কয়েকটি রাজ্য ইতিমধ্যে নজির তৈরি করেছে। নারেগা আইনের ২৯ নম্বর ধারাতেও বলা আছে, কাজ করানোর ১৫ দিনের মধ্যে শ্রমিককে মজুরির টাকা মিটিয়ে দিতে না-পারলে যত দিন দেরি হবে, সেই হিসেবে মজুরির উপরে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
কোনও রাজ্যেই শ্রমিকেরা ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি পান না বলে পঞ্চায়েত দফতর সূত্রের খবর। এই নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে স্বরাজ অভিযান নামে একটি সংস্থা। সর্বোচ্চ আদালত সেই মামলার সূত্রেই কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে, ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি মেটাতে না-পারলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। গত ৪ নভেম্বর ১০০ দিনের প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় যুগ্মসচিব অপরাজিতা সারেঙ্গি সব রাজ্যকে লিখিত ভাবে ক্ষতিপূরণ মেটানোর কথা জানিয়ে দেন। যদিও সর্বোচ্চ আদালতের এই নির্দেশের আগেই কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক দু’দফায় রাজ্যগুলিকে ক্ষতিপূরণের টাকা মেটাতে বলেছিল। তখন অধিকাংশ রাজ্য তাতে কান দেয়নি।
গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের খবর, মজুরি বকেয়া রাখার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ দেশে প্রথম। গত বছর শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়েও ২৪০০ কোটি টাকা মজুরি মেটায়নি রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতর। এ বছর এখনও পর্যন্ত বকেয়া মজুরির পরিমাণ প্রায় ১১০০ কোটি টাকা। অথচ এ বার এখনও পর্যন্ত ১০০ দিনের প্রকল্পে রাজ্যকে ৪০০০ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্র।
ক্ষতিপূরণের খাঁড়া
দিতে হবে
(কোটি)
দেওয়া হয়েছে
(লক্ষ)
২০১৩-১৪
২০১৪-১৫
২০১৫-১৬
২০১৬-১৭
৫৫.৯৯
১৫৫.৯৬
১১৬.৬২
১৪.৩৯
০০.০০
০০.০০
৭.০৩
০০.৩৬
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক কর্তার দাবি, ‘‘দেশের মধ্যে সব চেয়ে বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। শ্রমিকদের মজুরির টাকার পুরোটাই দেয় কেন্দ্র। তার পরেও দেখা যাচ্ছে, রাজ্য সময়ে মজুরি দিতে পারছে না। শ্রমিকদের মজুরির টাকা পেতে বছর গড়িয়ে যাচ্ছে।’’ রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতরের হিসেব থেকেও বকেয়া মজুরির যে-তথ্য মিলেছে, তা স্বস্তিকর নয়। ২০১৬-’১৭ অর্থবর্ষের নভেম্বরের গোড়া পর্যন্ত মজুরি বাবদ যে-১১০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে, তার মধ্যে ৮৮ কোটি টাকা আটকে আছে তিন মাসেরও বেশি। দু’মাসের বেশি আটকে রয়েছে ২৩৭ কোটি টাকা। আর এক মাসের বেশি আটকে রয়েছে ২৪১ কোটি টাকা। কী ভাবে কবে এই মজুরি মেটানো হবে, তা জানা নেই পঞ্চায়েতকর্তাদের।
রাজ্যে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কমিশনার দিব্যেন্দু সরকারের প্রশ্ন, ‘‘কেন্দ্রের টাকায় এই প্রকল্প চলে। কেন্দ্র সময়ে টাকা না-দিলে আমরাই বা সময়ে মজুরি মেটাব কী করে? রাজ্যের কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা ধার নিয়ে কোনও ক্রমে প্রকল্পটি চালু রাখা হয়েছে।’’ তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ক্ষতিপূরণ দিতে হলে সেটা দিতে হবে কেন্দ্রকেই।
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের কর্তারা জানাচ্ছেন, প্রকল্প চালু রাখার দায়িত্ব কেন্দ্রের। সেই জন্যই পশ্চিমবঙ্গকে সব চেয়ে বেশি, ৪০০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের পরে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা দিতে না-পারলে বেকার ভাতা এবং কাজ করানোর পরে ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি দিতে না-পারলে ক্ষতিপূরণ মেটানোর দায় রাজ্যের। সেই হিসেবে রাজ্যকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩৪৩ কোটি টাকার ভার তো নিতেই হবে।
ওই মন্ত্রকের বক্তব্য, আর কোনও রাজ্যে শ্রমিকদের মজুরি এত বকেয়া পড়ে নেই। কেন এ রাজ্যে এত বকেয়া থাকে, তা খতিয়ে দেখা হবে। মন্ত্রকের এক কর্তা জানাচ্ছেন, উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে মজুরি বকেয়া বাবদ ক্ষতিপূরণ মেটাতে হবে মাত্র ১০৫ কোটি টাকা। তামিলনাডুকে দিতে হবে ১০০ কোটি। সেখানে পশ্চিমবঙ্গকে মজুরি আর ক্ষতিপূরণ মিলিয়ে দিতে হবে প্রায় ১৪৫০ কোটি টাকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy