আমসত্ত্ব দুধে ফেলার পরে ঠিক কী কী ঘটে, তা জানিয়ে গিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ! গোগ্রাস আস্বাদের হাপুস-হুপুস ছাড়া সব শব্দ তখন অবান্তর। আর দৃশ্য বলতে তখন শুধু পাতে পিঁপড়ের কেঁদে কেঁদে ফেরা!
বিশ্ববাজারে সেই আমসত্ত্বের মহিমা মেলে ধরতেই রাজ্য সরকার এখন ব্যগ্র। নলেনগুড়, জয়নগরের মোয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানার মতো আমসত্ত্বও বাংলার গর্বের অন্যতম নিশান। বাঙালির রসনাবিলাসের একটি বড় উপকরণ। বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তার উৎপাদন বাড়ানোর তৎপরতা তুঙ্গে। এ বার আমের ব্যাপক ফলন হয়েছে। ফলে আমসত্ত্বের মূল উপকরণের অভাব আপাতত নেই। সাগরপারে আম রফতানির সঙ্গে সঙ্গে তাই আমসত্ত্বেও বিশ্বরসনা মোহিত করে দেওয়ার সুযোগ নিতে চাইছে নবান্ন। কিন্তু উৎপাদনে ঝক্কি আছে।
বরকত গনি খান চৌধুরীর বাড়ি যেখানে, আমসত্ত্বের পীঠস্থান মালদহের সেই কোতোয়ালি। আমসত্ত্ব বিক্রেতা ডালিম দাস জানেন, সেরা আমসত্ত্ব মেলে ঘন, আঁশওয়ালা রসের আম থেকেই। গোপালভোগ ও হিমসাগরের আমসত্ত্বের জুড়ি নেই।
মা-ঠাকুরমারা সে-কালে ঘরে ঘরে নিজের হাতে টুসটুসে পাকা আমের রস নিংড়ে রোদে শুকোতে দিতেন। তার জন্য স্নান সেরে শুদ্ধবস্ত্রে প্রাণান্তকর ধকল নিতে হতো। বাঁশের চাটাই পেতে পরিষ্কার গামছায় ছেঁকে দফায় দফায় পড়ত রসের প্রলেপ। দিনে পাঁচ-সাত বার চলত এই যজ্ঞি। আমসত্ত্ব তৈরি হতে সাত দিন।
আরও খবর
পথ দেখিয়ে উদাসীন কলকাতাই
এক ফোঁটা চিনির রস বা অন্য কোনও উপাদান মিশবে না তাতে। গুড়ের মতো মিষ্টি আমসত্ত্ব, লজেন্সের মতো চুষে বা বিস্কুটের মতো ভেঙে খাওয়া যাবে। এই উৎপাদন-পর্বে মা-দাদিরা রোদে পুড়ে ঝামা হতেন, কখনও বা খুদেদের ডিউটি পড়ত ছাদে পাখি তাড়ানোর। এ কালে অত ঝক্কি পোহাবেটা কে? তাই মালদহের এমন উৎকর্ষ সৃষ্টিতেও ভাটার টান।
মালদহ ম্যাঙ্গো মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা উজ্জ্বল চৌধুরীদের ৪৫ বিঘা আমবাগান। শৈশব জুড়ে অননুকরণীয় আমসত্ত্বের স্মৃতি। ‘‘ঘরের মেয়েরাই তো আগে আমসত্ত্বের চর্চা করত। এখন অত সময় কার আছে,’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন উজ্জ্বলবাবু। তবে আমসত্ত্ব ছাড়া আমও বাঁচবে না, বিলক্ষণ বোঝেন তিনি। তা কেন?
উজ্জ্বলবাবুর ব্যাখ্যা, আমকে লাভজনক করতে আমজাত পণ্যের চর্চা জরুরি। মালদহে ব্যাপক ফলন হয় আমের। ভাল আমের দর ২০-২৫ টাকা কিলোগ্রাম। সেরা আমসত্ত্ব কিন্তু ৫০০-১৫০০ টাকা কেজি। আমের আচার, জ্যামজেলি, আমকাসুন্দি ইত্যাদির মধ্যে আমসত্ত্বই রাজা। জেলায় ফি-মরসুমে ৮০০-৯০০ কুইন্টাল আমসত্ত্ব তৈরি হয়। সেই উৎপাদন আরও যাতে বাড়ে, তার জন্য চলছে প্রযুক্তির খোঁজ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষি বিপণন দফতরের কর্তারা সদ্য মিটিং করেছেন মালদহে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা উদ্বিগ্ন আমসত্ত্ব তৈরির পরিকাঠামো নিয়ে। ইদানীং কমবেশি যন্ত্রের প্রয়োগ হলেও আমসত্ত্বের কারবারিরা বলছেন, মেশিনে আমসত্ত্ব তৈরির ফলে রসের ঘনত্ব মাপমতো হচ্ছে না। রসের গাঢ় প্রলেপ শুকোনোর কসরতও ‘ড্রায়ারে’ ঠিক জমছে না। রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার অবশ্য আশাবাদী, রাস্তা ঠিক বেরোবেই। কেরলে তো দিব্যি যন্ত্রেই আমসত্ত্ব হচ্ছে। এখানেও কথা চলছে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। পাকা আমের রস ছেঁচে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটির জন্য চলছে অধীর প্রতীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy