সুপুরডি গ্রামে ত্রিলোচনের বাড়ির সামনে জটলা। ছবি: সুজিত মাহাতো
বিজেপি করাই কি ছেলের অপরাধ? বিজেপির যুব মোর্চার কর্মী ত্রিলোচন মাহাতোর মৃত্যুর পর থেকে যাঁকে সামনে পাচ্ছেন, তাঁকেই এই প্রশ্ন করে যাচ্ছেন নিহতের বাবা হাড়িরাম মাহাতো। একই প্রশ্ন তাঁর স্ত্রী পানো মাহাতোরও।
বলরামপুরের সুপুরডি গ্রামের কলেজ পড়ুয়া এই যুবক মঙ্গলবার বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। রাতে শুধু একবার দাদাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, তাঁকে কারা মোটরবাইকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বাঁচানোর আর্তি জানিয়েছিলেন।
কিন্তু, রাতভর পুলিশ এবং সুপুরডি ও লাগোয়া শ্যামনগরের প্রায় দু-আড়াইশো ছেলেপুলে আশপাশের এলাকা তল্লাশি চালিয়েও হদিস পাননি ত্রিলোচনের। সকালে গ্রাম থেকে কিছু দূরে গাছ থেকে ত্রিলোচনের গলায় ফাঁস দেওয়া ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। ত্রিলোচনের টি-শার্টে ও পায়ের তলায় কাগজে লেখা ছিল, তাঁর বিজেপি করা আততায়ীরা মেনে নেননি।
শোকার্ত বাবা হাড়িরাম মাহাতো।
বুধবার বলরামপুর থানায় অভিযোগ জানাতে আসা নিহতের বাবার মুখেও সেই আক্ষেপ। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার ছেলে বিজেপি করত, সেটাই কি অপরাধ হল?’’ যাঁরা পাশে ছিলেন, তাঁরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ততক্ষণে ত্রিলোচনের দেহ নিয়ে পুরুলিয়ার মর্গে পৌঁছে গিয়েছেন তাঁর দুই দাদা বিবেকানন্দ ও শিবনাথ।
বলরামপুর ব্লক সদর থেকে তখন কয়েক কিলোমিটার দূরে সুপুরডি গ্রামেও ত্রিলোচনের বাড়িতেই ঘুরছে সেই এক প্রশ্ন। টালির ছাউনির কাঁচা আধো অন্ধকার ঘরে শোকে পাথর পানোদেবী ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। আর মাঝে মধ্যে ছেলের নাম ধরে বিলাপ করছিলেন। কোনওরকমে সামাল দিয়ে তিনিও প্রশ্ন করেন— ‘‘না হয়ে আমার ছেলে বিরোধী রাজনীতি করত। ভোটে জেতার পরে পটকা ফাটিয়েছিল। তার বিনিময়ে ছেলেটার প্রাণ নিয়ে নেবে ওরা? এটাই কি রাজনীতি?’’
এই প্রশ্নটাই ঘুরছে ওই তল্লাটে। কারণ শুধু নিজের ঘরের দেওয়ালেই নয়, গ্রামেরও কিছু দেওয়ালে এ দিনও জ্বলজ্বল করছিল তাঁরই হাতে লেখা বিজেপির প্রচার। দলের কর্মী আশিস মাহাতো, আনন্দ মাহাতো, সন্তোষকুমার মাহাতোদের কথায়, ‘‘ভোটের কয়েক মাস আগেই বদলে গিয়েছিল গ্রামটা। রাতারাতি এক দল ছেলে বিজেপি করতে নেমে পড়ি। ত্রিলোচনও ছিলেন। স্বপ্নেও ভাবিনি, ওকে খুন করে দেবে।’’
আরও পড়ুন: গাছ থেকে ঝুলছে গলায় ফাঁস লাগানো শরীরটা, টি-শার্টে লেখা, ‘বিজেপি করা! এ বার বোঝ...’
এই এলাকার বিজেপির পঞ্চায়েত প্রমুখ সুনীল মাহাতোকে ভোটের আগেই মারধরের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। সদ্য তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। বিজেপির জেলা সম্পাদক বিবেক রঙ্গা ও বলরামপুর মণ্ডল কমিটির নেতা গোপাল কাটারুকা বলেন, ‘‘সুনীল জেলে যাওয়ার পরে ত্রিলোচনের মতো কয়েকটি ছেলেই এলাকায় দলের হয়ে ভোট পরিচালনা করেছিলেন। তাঁরা ঘাম ঝরিয়ে দলকে এখানে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তা তৃণমূলের সহ্য হয়নি।’’ স্থানীয় তেঁতলো গ্রাম পঞ্চায়েত এ বার তৃণমূলের হাত থেকে বিজেপি ছিনিয়ে নিয়েছে। ১৩টার মধ্যে ৯টিই পেয়েছে বিজেপি। সুপুরডি গ্রাম সংসদ তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে। যদিও তৃণমূল নেতা তথা বিদায়ী জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘ওই ঘটনায় আমি মর্মাহত। আমি চাই না, বলরামপুরের শান্তি নষ্ট হোক।’’
বিজেপির ওবিসি মোর্চার জেলা নেতা সুভাষ মাহাতো ও বাঁটু মাহাতো সকালেই ঘটনাস্থলে যান। দেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে বলরামপুর থানায় জমায়েত করেন বিজেপি কর্মীরা ও বজরং দলের সদস্যেরা। দুপুরে পুরুলিয়া শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিজেপি কর্মীরা। পরে বিজেপি আজ বৃহস্পতিবার বলরামপুরে ১২ ঘণ্টার বন্ধের ডাক দেয়।
জেলা পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, খুনের পিছনে ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকতে পারে। সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy