Advertisement
E-Paper

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যের উপর বিপুল অর্থসংস্থানের চাপ, কোথা থেকে মিলবে বকেয়া মহার্ঘভাতার ২৫ শতাংশ টাকা

গত এপ্রিল থেকে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ৪ শতাংশ হারে ডিএ বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ করা হয়েছে। তার পরেও কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের ডিএ-র ফারাক প্রায় ৩৭ শতাংশ। এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর কী ভাবছে রাজ্য সরকার?

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৫ ২১:৫৭
DA case

ডিএ মামলায় সুপ্রিম নির্দেশের পরে চাপের মুখে মমতা সরকার? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘভাতার (ডিএ) ২৫ শতাংশ দিয়ে দিতে হবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এমনই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার বিচারপতি সঞ্জয় করোল এবং বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চ ওই নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশ অনুযায়ী যে অর্থের সংস্থান করতে হবে রাজ্য সরকারকে, তার পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার একটু বেশি।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল বলে মনে করছেন শাসক শিবির এবং রাজ্য প্রশাসনের একাংশ। তাঁরা আরও উদ্বিগ্ন আগামী বছর বিধানসভা ভোট থাকায়। প্রত্যাশিত ভাবেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সম্পর্কে মমতা অবহিত। কিন্তু ওই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সহকর্মীদের কারও বিশদে আলোচনা হয়েছে বলে খবর নেই। ওই বিষয়ে দল বা সরকারের তরফে শুক্রবার কেউ মুখ খোলেননি। একটি সূত্রের দাবি, ওই বিষয়ে যা বলার মুখ্যমন্ত্রীই বলবেন।

তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর মতে, এখন রাজ্য সরকারের কাছে দু’টি রাস্তা আছে। এক, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতের অন্য বেঞ্চে মামলা করা। দুই, বিভিন্ন জন কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে আর্থিক বরাদ্দ কাটছাঁট করে মহার্ঘভাতার জন্য প্রদেয় অর্থ জোগাড় করা। তার মধ্যে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পও রয়েছে। যে প্রকল্পে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে অর্থবরাদ্দ বৃদ্ধি করার প্রাথমিক ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল। প্রথমটির (নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ) সম্ভাবনা ‘ক্ষীণ’ বলে একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন ওই নেতা-মন্ত্রীরাই। দ্বিতীয় পন্থা নিতে হলে কী পদক্ষেপ করা হতে পারে, তার আভাস দিলেও কোন পথে তা কার্যকর করা যাবে, তার হদিস তাঁরা দিতে পারছেন না।

প্রসঙ্গত, রাজ্যকে ওই বকেয়া অর্থ কত দিনের মধ্যে দিতে হবে, তা নিয়ে দ্বিমত সংশয় রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, চার সপ্তাহের মধ্যে ওই টাকা দিতে হবে। আবার অন্য অংশ মনে করছেন, মামলার পরবর্তী শুনানি যেহেতু আগামী অগস্টে, তাই রাজ্যের কাছে তিন মাস সময় রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কী সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বা আদৌ দিয়েছে কি না, রায়ের হুবহু প্রতিলিপি পাওয়া গেলে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে বকেয়া মহার্ঘভাতার ২৫ শতাংশ যে রাজ্য সরকারকে দিতে হচ্ছেই, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

কেন্দ্রের হারে মহার্ঘভাতা দিতে হবে বলে দাবি জানিয়ে বছর কয়েক আগে মামলা হয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টে। ২০২২ সালের ২০ মে হাই কোর্ট জানায়, কেন্দ্রের সমতুল ৩১ শতাংশ হারে মহার্ঘভাতা দিতে হবে রাজ্যকে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় রাজ্য। ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর প্রথম বার ওই মামলার শুনানি হয় সুপ্রিম কোর্টে। তার পরে অন্তত ১৮ বার শুনানি পিছিয়েছে। শুক্রবার শীর্ষ আদালত জানাল, হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণে ভুল নেই। রাজ্য সরকারি কর্মীদের যে পরিমাণ মহার্ঘভাতা বকেয়া রয়েছে, তার মধ্যে আপাতত ২৫ শতাংশ দিয়ে দিতে হবে। বস্তুত, গত এপ্রিল থেকে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ৪ শতাংশ হারে ডিএ বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা ৩৯ শতাংশ মহার্ঘভাতা পান। তার পরেও কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের মহার্ঘভাতার ফারাক প্রায় ৩৭ শতাংশ।

শুক্রবারের নির্দেশের পর রাজ্য সরকারকে ওই বাড়তি অর্থের সংস্থান করতে হবে। তা কোন পথে হবে, তা নিয়েই জল্পনা। সরকারের তরফে আইনি বিষয়টি যাঁরা দেখছেন, তাঁদের একাংশের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছে, তা চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সরকার অন্য কোনও বেঞ্চে মামলা করবে, এমন সুযোগ বা সম্ভাবনা কার্যত নেই। তবুও আইনি দিকগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্য দিকে, রাজ্যের কোষাগারের অবস্থা তথৈবচ। বিভিন্ন জনমোহিনী প্রকল্প চালাতে গিয়ে সরকারকে কত ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হচ্ছে, সে কথা নিজেই প্রশাসনিক বৈঠকে বলে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক একটি তথ্য দিয়েছিল সংসদে। তাতে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবর্ষের শেষে পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি-র তুলনায় ঋণের হার ৩৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকতে পারে। আর ঋণের বোঝার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে। এই পরিস্থিতিতে বকেয়া মহার্ঘভাতার ২৫ শতাংশ দেওয়া সরকারের কাছে গোদের উপর বিষফোড়ার শামিল।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘রাজ্যের প্রচুর অর্থ আটকে রেখেছে কেন্দ্র। কিন্তু জনসাধারণের স্বার্থে ওই প্রকল্পগুলি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকার। এখন রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে আবাস যোজনা, ১০০ দিনের কাজ থেকে গ্রামীণ সড়ক যোজনার টাকাও দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে নির্ধারিত বরাদ্দও রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোন খাত থেকে কাটছাঁট করে ডিএ-র টাকা জোগাড় করা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’’ তিনি এ-ও জানান যে, এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা তথা রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের পরামর্শ নেওয়া হতে পারে। নবান্নের একটি সূত্রে খবর, মহার্ঘভাতা সংক্রান্ত বিষয়ে যা বলার, কয়েক দিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তা বলবেন। সেই আভাস মিলেছে অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কথাতেও। তিনি শুক্রবার বলেছেন, ‘‘এ নিয়ে আমি এখন কোনও মন্তব্য করব না।’’

উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় সব সময় খারাপ চোখে দেখেন না অর্থনীতিবিদদের বড় অংশ। তবে সেই ব্যয় মূলত সড়ক, সেতু বা বন্দরের মতো ‘স্থায়ী সম্পদ’ তৈরি করতে ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেন তাঁরা। কারণ, তাতে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক কর্মকাণ্ড বাড়ে। সেই সূত্রে রাজস্ব আদায়ও বাড়ে রাজ্যের। যেমনটা রাজ্য করছে গ্রামীণ সড়ক যোজনা বা ১০০ দিনের কাজের মতো প্রকল্পে। আবাস যোজনার প্রথম কিস্তির টাকা ইতিমধ্যে উপভোক্তাদের কাছে চলে গিয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে পরের কিস্তির টাকা দেওয়ার কথা। পথশ্রী প্রকল্পের (সড়ক যোজনা) কাজ বহু জায়গায় চলছে। এখন প্রশ্ন, বরাদ্দে কাটছাঁট হলে এই প্রকল্পগুলির কাজ কি আপাতত বন্ধ হয়ে যাবে? শাসকদলের এক নেতার কথায়, ‘‘এই কাজগুলি বন্ধ হয়ে গেলে সরাসরি জনজীবনে তার প্রভাব পড়বে। সেই প্রভাব পড়তে পারে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে।’’ তাঁর যুক্তি, সরকারি কর্মচারি এবং পেনশনভোগী প্রায় ১০ লক্ষ। তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষের রুজিরুটি জড়িয়ে আছে সামাজিক প্রকল্পগুলিতে। উপভোক্তারও সংখ্যাও অনেক।

সব মিলিয়ে টানাপড়েনে রাজ্য। সমস্যা সমাধানের স্পষ্ট কোনও দিক্‌নির্দেশ মিলছে না নেতা-মন্ত্রীদের কথায়। ওই মামলায় মামলাকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করেন, সামাজিক প্রকল্প থেকে অর্থ কাটছাঁট না করেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করা যাবে। তাঁর এ-ও দাবি যে, ওই মামলায় রাজ্য সরকারের কাছে আইনি সুযোগ আর নেই। তিনি বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ মেনে রাজ্য সরকারের পক্ষে এই টাকা দেওয়া সম্ভব। কোষাগার থেকে মন্দির তৈরি হচ্ছে। ইমামদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। দুর্গাপুজোর সময় ক্লাবগুলোকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করে দিয়ে মহার্ঘভাতার অর্থ জোগাড় করা কঠিন কিছু বলে আমার মনে হয় না। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করতে হবে না।’’

DA Case CM Mamata Banerjee TMC government Supreme Court DA
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy