Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Mamata Banerjee

মমতাকে টক্কর! জুতসই মুখের খোঁজে তর্ক বাড়ছে সঙ্ঘ-বিজেপিতে

এত দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশই থাকত না, যদি প্রতিপক্ষের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না হত, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২০ ১২:০০
Share: Save:

লড়াই দেওয়ার মতো হাওয়া বাধতে শুরু করেছে পালে। পশ্চিমবঙ্গের মসনদ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উৎখাত করার স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে বিজেপি। কিন্তু বিকল্প মুখ কোথায়? নরেন্দ্র মোদীর মুখ দেখিয়ে লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা দেওয়া গিয়েছিল তৃণমূলকে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে তো স্থানীয় মুখ দরকার। সে মুখ কি রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ভাবমূর্তির দিলীপ ঘোষই? নাকি কোনও সুশীল, সৌম্যবচন রাজনীতিক, যাঁকে বিদ্বজ্জনদের তালিকাতেও ঠাঁই দেওয়াই যায়? বিজেপির বাইরে এ নিয়ে তর্ক তো রয়েছেই। বিজেপির ভিতরেও এখন জোর মন্থন শুরু হয়েছে এই প্রশ্নকে ঘিরে।

প্রশ্নটা নতুন নয়, আগেও ছিল। কিন্তু এত প্রবল ভাবে চর্চিত ছিল না। তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি হতে পারে কি না, সে প্রশ্ন উঠলেই রাজ্য বিজেপির ‘নেতৃত্বহীনতা’র কথা বলতে শোনা যেত রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের একাংশকে। ২০১৯ সালের আগে পর্যন্ত সে প্রশ্নের জুৎসই জবাব বিজেপির কাছে ছিল না। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপি ১৮ আসন জেতার পর থেকে দিলীপ ঘোষের ওজন অনেক বেড়ে যায়। ভোটের আগে দিলীপই স্লোগান তুলেছিলেন— ‘উনিশে হাফ, একুশে সাফ’। উনিশের ফলাফলে তৃণমূলের আসনসংখ্যা প্রায় সেই ‘হাফ’-ই হয়ে যায়। ফলে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার আর অবকাশই নেই বলে দিলীপ অনুগামীরা দাবি করতে শুরু করেন।
বিরোধীদের জন্য জুৎসই জবাব খুঁজে পেলেও দলের অন্দরে চলতে থাকা তর্ককে কিন্তু থামাতে পারেনি দিলীপ শিবির। ২০১৯-এর ভোটের ফলাফল দিলীপ ঘোষের কৃতিত্ব নয়, কৃতিত্বটা মোদী ঝড়ের— এমনই দাবি বিজেপির একটি অংশের। শুধু বিজেপি নেতাদের একাংশ অবশ্য নয়, রাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশও তেমনটা মনে করেন। দিলীপের কৃতিত্বেই যদি লোকসভা নির্বাচনে জয় এসে থাকে, তা হলে সেই ভোটের কয়েক মাস পারে রাজ্যের ৩টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে কেন জেতা আসনও হারতে হল বিজেপি-কে? এই প্রশ্ন নিয়েও চর্চা শুরু হয় ঘরে-বাইরে।

আরও পড়ুন: ডিএ মামলায় ফের ধাক্কা খেল রাজ্য, রিভিউ পিটিশন খারিজ করল স্যাট​

এই পরিস্থিতিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কী ভাবছে? একাধিক বার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে জানানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে কাউকে তুলে ধরে নির্বাচনে যাবে না বিজেপি। নির্বাচনে জয় যদি আসে, তখন মুখ্যমন্ত্রী বেছে নেওয়া হবে। যে সব রাজ্যে বিজেপি প্রথম বার ক্ষমতা দখলের জন্য লড়ে, সেই সব রাজ্যে এই নীতিই অনুসৃত হয় বলেও বিজেপি নেতৃত্বের ব্যাখ্যা। দিলীপ ঘোষ নিজেও সে কথাই বলছেন। কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপির বেনজির সাফল্য যে হেতু দিলীপ ঘোষের সভাপতিত্বের মেয়াদেই এসেছে, যে হেতু কঠিন সময়ে দিলীপ ‘সামনে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ছেন’, সে হেতু দল জিতলে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রিত্ব তাঁরই প্রাপ্য বলে দিলীপের অনুগামীরা সুর চড়াচ্ছেন ক্রমশ।
বিজেপির অন্দরে অনেক প্রভাবশালীই অবশ্য দিলীপ অনুগামী নন। তাঁদের অনেকেরই শিকড় আবার দল তথা সঙ্ঘের (আরএসএস) বেশ গভীরে। অতএব দিলীপ ঘোষ এখনও নিরঙ্কুশ হয়ে উঠতে পারেননি রাজ্য বিজেপিতে। যে নীতি নিয়ে দিলীপ ঘোষ দল চালাচ্ছেন, সেই ‘ঢিলের বদলে পাটকেল’ নীতি এই মুহূর্তে বঙ্গ বিজেপির জন্য যে জরুরি, সে কথা ওই প্রভাবশালী বিজেপি নেতারাও মানেন। কিন্তু বাংলার জনমতের পুরোভাগে বরাবর থাকেন যে শিক্ষিত এবং বুদ্ধিবৃত্তিপ্রেমী মধ্যবিত্তরা, তাঁদের পছন্দের মঞ্চশোভন শহুরেয়ানা দিলীপ ঘোষের মধ্যে নেই। সুতরাং দিলীপ ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরে ভোটে গেলে শহুরে মধ্যবিত্তদের একাংশ মুখ ফিরিয়ে থাকবেন বলে বিজেপির ওই প্রভাবশালী অংশটাই মনে করছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টক্কর দেওয়ার জন্য দিলীপ ঘোষ কি যথেষ্ট? প্রশ্ন উঠছে বিজেপির অন্দরেই। —ফাইল চিত্র।

এত দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশই কিন্তু থাকত না, যদি প্রতিপক্ষের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না হত, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাপের রাজনীতিক এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে কেউ নেই। ব্যক্তিত্ব, ভাবমূর্তি এবং এ দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সুবাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত উজ্জ্বল নাম সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও। পশ্চিমবঙ্গে শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও এই মুহূর্তে এমন কোনও বাঙালি নেই (প্রণব মুখোপাধ্যায় যে হেতু প্রায় অবসরে), যিনি মমতার চেয়েও বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এ হেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টক্কর দেওয়ার জন্য দিলীপ ঘোষ কি যথেষ্ট? প্রশ্নটা এই নিয়েই।
পাল্টা প্রশ্নও অবশ্য রয়েছে। রাজ্য বিজেপিতে ঠিক কে এমন রয়েছেন, যিনি ভাবমূর্তিতে, জনভিত্তিতে এবং রাজনৈতিক উচ্চতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমকক্ষ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কারও দ্বিধা নেই। সকলেই মানছেন, তেমন কেউ নেই। তা হলে দিলীপে আপত্তি কিসের? সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘আপত্তি শুধু ভাবমূর্তিটা নিয়ে। শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে আদর্শ মুখ্যমন্ত্রীর যে মুখ ভাসে, সে মুখ উচ্চশিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের মুখ, যিনি বিদ্বৎ বা সুশীল সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোত। দিলীপ ঘোষ অত্যন্ত লড়াকু এবং আত্মবিশ্বাসী নেতা। কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্তদের একাংশের পছন্দের মুখ নন।’’

শহুরে মধ্যবিত্তদের একাংশের পছন্দের না-ই বা হলেন, তাতে কী যায়-আসে? ওঁরা মোট ভোটের কত শতাংশই বা? ওই বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘মোট ভোটের প্রেক্ষিতে ওঁদের সংখ্যাটা বিরাট নয়। কিন্তু জনমতকে একটা দিশায় নিয়ে যেতে এই শহুরে মধ্যবিত্তরাই বরাবর অগ্রগণ্য। তাই ওঁদের বিশ্বাস জিততে পারাটা জরুরি।’’
যে বিজেপি নেতা এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তিনি সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ হলেও, এ রাজ্যে সঙ্ঘের শীর্ষনেতারা কিন্তু এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। মুখ্যমন্ত্রীর আদর্শ ভাবমূর্তি প্রসঙ্গে এক আরএসএস পদাধিকারীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘উচ্চশিক্ষিত, সৌম্যবচন, বিদ্বজ্জন? এই রকম মুখ্যমন্ত্রী পছন্দ করে বাঙালি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই রকম ভাবমূর্তির মুখ্যমন্ত্রী?’’ শুধু মমতার নয়, জ্যোতি বসুর ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সঙ্ঘ নেতারা। জ্যোতি বসুর গায়ে লেগে থাকা ‘ব্রিফলেস ব্যারিস্টার’ তকমা মনে করাচ্ছেন তাঁরা। উচ্চশিক্ষিত হলেও জ্যোতি বসু এমন কোনও লেখা বা রচনা নেই, যা কোনও অসামান্য বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় দেয়, বলছেন সঙ্ঘের এক পদাধিকারী। সঙ্ঘ সূত্রের ব্যাখ্যা— পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে হলে বিদ্বজ্জন হতে হয় বা প্রেসিডেন্সির ছাত্র হতে হয়, এই মিথ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন।
সঙ্ঘের ভাবনা যেমনই হোক, বিরোধী শিবিরে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগের শেষ কয়েক বছরে বিদ্বজ্জন তথা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে চোখের পড়ার মতো যোগাযোগ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। বলছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই তাঁকে ঘিরে কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পরিচালক, সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পীদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছিল। তাঁদের প্রতি অত্যন্ত সমাদর দেখিয়ে তাঁদের আরও বেশি করে কাছে টানতে মমতাও চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। ফলে মমতা যে সুশীল সমাজের পৃষ্ঠপোষক এবং বাঙালি সুশীল সমাজ যে মমতার পাশেই রয়েছে, এমন একটা ধারণাও তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত এমনই। দিলীপ ঘোষ সেটা পারেননি এবং দিলীপকে সামনে রেখে বিজেপি সেটা পারবেও না, বলছেন ওই বিশ্লেষকরা।
সঙ্ঘ সূত্র অবশ্য অন্য কথা বলছে। সঙ্ঘের কথায়, বিদ্বজ্জন বা নানা ক্ষেত্রের জ্ঞানী-গুণী ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বদের সব সময়েই সমাদর করে আরএসএস। একই নীতি বিজেপি-ও অনুসরণ করছে বলে সঙ্ঘের মত। যাঁরা প্রকাশ্যে বিজেপির বিরোধিতা করছেন বা বিজেপি-কে আক্রমণ করছেন, তাঁদেরকে প্রত্যাঘাত করাটা অনেক ক্ষেত্রে বিজেপির জন্য রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায় বলে তাঁদের মত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজকে কাছে টানার চেষ্টা নিরন্তর চলছে এবং অনেকেই সঙ্ঘের বা বিজেপির রাজনীতির প্রতি আস্থা ব্যক্ত করছেন বলে সঙ্ঘ সূত্রের দাবি।
সঙ্ঘ যদি দিলীপের প্রতি এতই আস্থাশীল হয়, তা হলে দিলীপকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরে ভোটে যেতে কী সমস্যা? সঙ্ঘের তরফে জানানো হচ্ছে, এটা পুরোপুরি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিষয়। কাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হবে, বা আদৌ কাউকে তুলে ধরা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত বিজেপি-কেই নিতে হবে এবং সঙ্ঘ কোনও ভাবেই তাতে নাক গলাবে না। দিলীপ ঘোষ যে হেতু দীর্ঘ দিন সঙ্ঘে কাজ করেছেন, সে হেতু দিলীপ ঘোষ সম্পর্কে সঙ্ঘের মূল্যায়ন রয়েছে, কিন্তু বিজেপির তরফ থেকে দিলীপ ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হবে কি না, তার সঙ্গে ওই মূল্যায়নের কোনও সম্পর্ক নেই— জানানো হচ্ছে আরএসএস-এর তরফ থেকে।

অমিত সাহের পুত্র জয় শাহ এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জুটি এখন শাসন করছে ভারতীয় ক্রিকেটকে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সৌরভের ঘনিষ্ঠতা নিয়েও গুঞ্জন যথেষ্টই।—ফাইল চিত্র।

সঙ্ঘের নেতারা মন্তব্য করতে না চাইলেও বিজেপি নেতারা কিন্তু ঘনিষ্ঠ পরিসরে মুখ খুলছেন। তাতে দিলীপের বিকল্প নাম ভেসেও বেড়াচ্ছে। কখনও শোনা যাচ্ছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম, কখনও স্বপন দাশগুপ্তর। কেউ বলছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র কথা, কোনও শিবির থেকে আবার ভেসে আসছে তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা তথা রাজ্যের বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর নামও। তৃণমূলকে টক্কর দিতে দিলীপ ঘোষের মুখই যথেষ্ট, এই বিশ্বাস যদি থাকত, তা হলে কি এতগুলো বিকল্প নাম সামনে আসত? প্রশ্ন তুলছেন রাজ্য বিজেপির-ই কয়েক জন।

ভারতীয় ক্রিকেট টিমের প্রাক্তন অধিনায়ক তথা বিসিসিআই-এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু বাঙালির জন্য বিরাট বড় আবেগ। সেটা রাজনৈতিক আবেগ নয় ঠিকই। কিন্তু সৌরভের জনপ্রিয়তাকে রাজনীতির মঞ্চে কাজে লাগানো খুব একটা শক্ত হবে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন। বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সৌরভের যোগাযোগ বেশ ঘনিষ্ঠও। বিসিসিআই-এর সচিব পদে যখন অমিত শাহের ছেলে জয় নির্বাচিত হলেন, তখনই সভাপতি পদে সৌরভের নির্বাচিত হওয়া ইঙ্গিতবহ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই মত।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে কিন্তু সঙ্ঘেরও কোনও আপত্তি নেই বলে খবর। সঙ্ঘ সূত্র বলছে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যদি আগ্রহী হন, তা হলে তো অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, সৌরভ তো ‘স্বাভাবিক পছন্দ’। কিন্তু সৌরভ কি আদৌ সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখতে আগ্রহী? এ প্রশ্নও থাকছে। সৌরভ নিজে একবারও সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত দেননি। নিজের ঘনিষ্ঠ মহলকেও সৌরভ তেমন কিছু বলেছেন বলে শোনা যায়নি। তাই ওই নাম নিয়ে এখনই আলোচনা অর্থহীন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই।

মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে বাবুল সুপ্রিয়র নামও মাঝেমধ্যে ভেসে উঠছে। —ফাইল চিত্র।

বাবুল সুপ্রিয় রাজ্যের রাজনীতিতে খুব একটা সড়গড় নন, বরাবরই জাতীয় রাজনীতির অলিন্দেই তাঁর ঘোরাফেরা, বলছে বিজেপির একাংশ। বাবুলকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার সম্ভাবনা খুব একটা দেখছেন না তাঁরা। আর শুভেন্দু অধিকারীকে তুলে ধরার জল্পনা আরওই অবান্তর বলে বিজেপি নেতাদের অধিকাংশই মনে করছেন। প্রথমত, শুভেন্দুকে নিয়ে যত রকম জল্পনাই চলুক, শুভেন্দু এখনও তৃণমূলেই রয়েছেন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভাতেই রয়েছেন। তাই শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে ভাবার সময়ই এখনও আসেনি বলে বিজেপি এবং সঙ্ঘের পদাধিকারীদের মত। দ্বিতীয়ত, শুভেন্দু যদি বিজেপিতে যোগও দেন, তা হলেও মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে দলে টানা হবে, এমনটা ভাবার জায়গাই নেই বলেও বিজেপি নেতারা জানাচ্ছেন। তৃণমূল থেকে সদ্য ভাঙিয়ে আনা কোনও নেতাকে দলের মুখ হিসেবে তুলে ধরে ভোটে যেতে হচ্ছে, এই বার্তা বিজেপি কিছুতেই দিতে চাইবে না। তা ছাড়া সঙ্ঘে একেবারেই শিকড় নেই, এমন কোনও নেতার পক্ষে আচমকা বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া বেশ কঠিন।
অতএব ভেসে বেড়ানো নামগুলোর মধ্যে পড়ে রইল একটাই— স্বপন দাশগুপ্ত। কলকাতার নামী স্কুল, দিল্লির নামী কলেজের ছাত্র তো বটেই, স্বপন দাশগুপ্তের উচ্চশিক্ষা লন্ডনে। পোস্ট ডক্টরেট তো খোদ অক্সফোর্ড থেকে। বড় মাপের পারিবারিক ব্যবসার সুবাদে বনেদিয়ানার ছাপও সহজাত। বিলেত থেকে ফেরার পরে সাংবাদিক তথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে দ্রুত বিখ্যাত হন। ৯০-এর দশক থেকে বিজেপি ঘনিষ্ঠ, আডবাণীর রামরথ যাত্রার সময় থেকে গেরুয়া শিবিরের অন্যতম সমাদৃত মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। এখনও কিন্তু বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ স্বপন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে চাইলেই যোগাযোগ করতে পারেন, বঙ্গ বিজেপিতে এই রকম নেতার সংখ্যা কয়েকটা মাত্র। তাঁদের মধ্যে স্বপন অগ্রগণ্য।
অর্থাৎ ক্ষমতাশালী, বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের খুব কাছের, বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ পথ চলা। তার পাশাপাশি আবার বনেদি বাঙালি পরিবার থেকে আসা উচ্চশিক্ষিত, বিদ্বৎ ভাবমূর্তি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে ভাল মুখ কি বিজেপির হাতে রয়েছে? অন্তত এই মুহূর্তে? প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিচ্ছে রাজ্য বিজেপির একাংশই।

আরও পড়ুন: রাজনীতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি সৌরভ, তবে গেলে টপেই থাকবে, বললেন ডোনা

বাংলার মাঠ-ময়দান যে ভাবে দিলীপ ঘোষ চেনেন, স্বপন দাশগুপ্ত ততটা সড়গড় কি না, প্রশ্ন রয়েছে। গ্রাম-বাংলার বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দিলীপ ঘোষের ‘লড়কে লেঙ্গে’ ভাবমূর্তি যে রকম তীব্র ভাবে জনপ্রিয় হয়েছে, স্বপন দাশগুপ্তকে নিয়ে সেই উন্মাদনা রয়েছে কি না, প্রশ্ন থাকতে পারে তা নিয়েও। কিন্তু জনমতকে দিশা দেখায় যে শ্রেণি, তাঁদের পছন্দ সম্পর্কে ভাবতে গেলে স্বপন দাশগুপ্তর নামও গুরুত্ব পাচ্ছে বলে বিজেপির-ই একাংশের দাবি।
বিজেপির কোনও নেতাই এই বিষয় নিয়ে এখন প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন। ব্যক্তিকে নয়, দলকে সামনে রেখে ভোটে লড়া হবে— এই তত্ত্ব আউড়ে প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন বিজেপি নেতাদের অধিকাংশই। তবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মুখ যে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ, সে কথাও বিজেপি বা সঙ্ঘ অস্বীকার করছে না পুরোপুরি। সঙ্ঘের বাংলা মুখপত্রের সম্পাদক তথা গত লোকসভায় হাওড়া থেকে বিজেপির টিকিটে লড়া রন্তিদেব সেনগুপ্তর কথায়, ‘‘বাংলার মানুষ চান, আমার নেতা আমার কাছের মানুষ হবেন। অর্থাৎ আমার নাগালের বাইরের কেউ নন, আমি যাঁর কাছে সহজেই পৌঁছতে পারব, আমার অভাব-অভিযোগ যিনি সহজেই বুঝতে পারবেন— এ রকম কেউ। আর একটা বিষয় বাংলার মানুষ দেখেন। সেটা হল নেতার জীবনযাত্রাটা কেমন। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে উপযুক্ত মুখ খুঁজে পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’’

মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য স্বপন দাশগুপ্তর নামও গুরুত্ব পাচ্ছে বিজেপির অন্দরে। —ফাইল চিত্র।

সঙ্ঘের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যে মাপকাঠির কথা বলছেন, তাতে দিলীপ বা স্বপন, দু’জনেই কিন্তু উতরে যাবেন। দিলীপ একেবারে গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা নেতা। আর স্বপন জাতীয় রাজনীতি অত্যন্ত সাবলীল হওয়া সত্ত্বেও বাংলার বিজেপি নেতা-কর্মীদের নাগালের মধ্যেই। দু’জনের জীবনযাত্রায় ফারাক রয়েছে। কিন্তু দিলীপ বা স্বপন, কারও জীবনযাত্রাই কালিমালিপ্ত নয়, বরং স্বচ্ছই। কার দিকে ইঙ্গিত করলেন সঙ্ঘ মুখপত্রের সম্পাদক? ভেঙে বলতে নারাজ রন্তিদেব। শুধু বলছেন, ‘‘আমাদের বিপরীতে যে হেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সে হেতু উপযুক্ত মুখ খুঁজে নিয়ে লড়তে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। দল নিশ্চয়ই তা খুঁজছে।’’ অর্থাৎ রাজ্য সভাপতিই যে মুখ্যমন্ত্রী-মুখ, তা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই? এ প্রশ্নের জবাব খোলাখুলি দিতে চাইছেন না কেউই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE