মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টক্কর দেওয়ার জন্য দিলীপ ঘোষ কি যথেষ্ট? প্রশ্ন উঠছে বিজেপির অন্দরেই। —ফাইল চিত্র।
এত দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশই কিন্তু থাকত না, যদি প্রতিপক্ষের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না হত, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাপের রাজনীতিক এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে কেউ নেই। ব্যক্তিত্ব, ভাবমূর্তি এবং এ দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সুবাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত উজ্জ্বল নাম সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও। পশ্চিমবঙ্গে শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও এই মুহূর্তে এমন কোনও বাঙালি নেই (প্রণব মুখোপাধ্যায় যে হেতু প্রায় অবসরে), যিনি মমতার চেয়েও বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এ হেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টক্কর দেওয়ার জন্য দিলীপ ঘোষ কি যথেষ্ট? প্রশ্নটা এই নিয়েই।
পাল্টা প্রশ্নও অবশ্য রয়েছে। রাজ্য বিজেপিতে ঠিক কে এমন রয়েছেন, যিনি ভাবমূর্তিতে, জনভিত্তিতে এবং রাজনৈতিক উচ্চতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমকক্ষ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কারও দ্বিধা নেই। সকলেই মানছেন, তেমন কেউ নেই। তা হলে দিলীপে আপত্তি কিসের? সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘আপত্তি শুধু ভাবমূর্তিটা নিয়ে। শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে আদর্শ মুখ্যমন্ত্রীর যে মুখ ভাসে, সে মুখ উচ্চশিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের মুখ, যিনি বিদ্বৎ বা সুশীল সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোত। দিলীপ ঘোষ অত্যন্ত লড়াকু এবং আত্মবিশ্বাসী নেতা। কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্তদের একাংশের পছন্দের মুখ নন।’’
শহুরে মধ্যবিত্তদের একাংশের পছন্দের না-ই বা হলেন, তাতে কী যায়-আসে? ওঁরা মোট ভোটের কত শতাংশই বা? ওই বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘মোট ভোটের প্রেক্ষিতে ওঁদের সংখ্যাটা বিরাট নয়। কিন্তু জনমতকে একটা দিশায় নিয়ে যেতে এই শহুরে মধ্যবিত্তরাই বরাবর অগ্রগণ্য। তাই ওঁদের বিশ্বাস জিততে পারাটা জরুরি।’’
যে বিজেপি নেতা এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তিনি সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ হলেও, এ রাজ্যে সঙ্ঘের শীর্ষনেতারা কিন্তু এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। মুখ্যমন্ত্রীর আদর্শ ভাবমূর্তি প্রসঙ্গে এক আরএসএস পদাধিকারীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘উচ্চশিক্ষিত, সৌম্যবচন, বিদ্বজ্জন? এই রকম মুখ্যমন্ত্রী পছন্দ করে বাঙালি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই রকম ভাবমূর্তির মুখ্যমন্ত্রী?’’ শুধু মমতার নয়, জ্যোতি বসুর ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সঙ্ঘ নেতারা। জ্যোতি বসুর গায়ে লেগে থাকা ‘ব্রিফলেস ব্যারিস্টার’ তকমা মনে করাচ্ছেন তাঁরা। উচ্চশিক্ষিত হলেও জ্যোতি বসু এমন কোনও লেখা বা রচনা নেই, যা কোনও অসামান্য বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় দেয়, বলছেন সঙ্ঘের এক পদাধিকারী। সঙ্ঘ সূত্রের ব্যাখ্যা— পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে হলে বিদ্বজ্জন হতে হয় বা প্রেসিডেন্সির ছাত্র হতে হয়, এই মিথ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন।
সঙ্ঘের ভাবনা যেমনই হোক, বিরোধী শিবিরে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগের শেষ কয়েক বছরে বিদ্বজ্জন তথা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে চোখের পড়ার মতো যোগাযোগ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। বলছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই তাঁকে ঘিরে কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পরিচালক, সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পীদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছিল। তাঁদের প্রতি অত্যন্ত সমাদর দেখিয়ে তাঁদের আরও বেশি করে কাছে টানতে মমতাও চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। ফলে মমতা যে সুশীল সমাজের পৃষ্ঠপোষক এবং বাঙালি সুশীল সমাজ যে মমতার পাশেই রয়েছে, এমন একটা ধারণাও তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত এমনই। দিলীপ ঘোষ সেটা পারেননি এবং দিলীপকে সামনে রেখে বিজেপি সেটা পারবেও না, বলছেন ওই বিশ্লেষকরা।
সঙ্ঘ সূত্র অবশ্য অন্য কথা বলছে। সঙ্ঘের কথায়, বিদ্বজ্জন বা নানা ক্ষেত্রের জ্ঞানী-গুণী ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বদের সব সময়েই সমাদর করে আরএসএস। একই নীতি বিজেপি-ও অনুসরণ করছে বলে সঙ্ঘের মত। যাঁরা প্রকাশ্যে বিজেপির বিরোধিতা করছেন বা বিজেপি-কে আক্রমণ করছেন, তাঁদেরকে প্রত্যাঘাত করাটা অনেক ক্ষেত্রে বিজেপির জন্য রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায় বলে তাঁদের মত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজকে কাছে টানার চেষ্টা নিরন্তর চলছে এবং অনেকেই সঙ্ঘের বা বিজেপির রাজনীতির প্রতি আস্থা ব্যক্ত করছেন বলে সঙ্ঘ সূত্রের দাবি।
সঙ্ঘ যদি দিলীপের প্রতি এতই আস্থাশীল হয়, তা হলে দিলীপকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরে ভোটে যেতে কী সমস্যা? সঙ্ঘের তরফে জানানো হচ্ছে, এটা পুরোপুরি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিষয়। কাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হবে, বা আদৌ কাউকে তুলে ধরা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত বিজেপি-কেই নিতে হবে এবং সঙ্ঘ কোনও ভাবেই তাতে নাক গলাবে না। দিলীপ ঘোষ যে হেতু দীর্ঘ দিন সঙ্ঘে কাজ করেছেন, সে হেতু দিলীপ ঘোষ সম্পর্কে সঙ্ঘের মূল্যায়ন রয়েছে, কিন্তু বিজেপির তরফ থেকে দিলীপ ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হবে কি না, তার সঙ্গে ওই মূল্যায়নের কোনও সম্পর্ক নেই— জানানো হচ্ছে আরএসএস-এর তরফ থেকে।