Advertisement
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
Madan Mitra IPAC

আইপ্যাককে ‘তোলাবাজ’ বলার পর ক্ষমা চেয়ে চিঠি, ছ’ঘণ্টার মধ্যেই মদনের ডিগবাজি, কী এমন ঘটল?

আইপ্যাক নিয়ে তৃণমূলের অনেক প্রবীণ নেতারই ‘অ্যালার্জি’ রয়েছে। কিন্তু মদন যে ভাবে সরাসরি তোলাবাজির অভিযোগ করেছিলেন, তা নজিরবিহীন। দলও মদনকে রেয়াত করেনি।

Why did Madan Mitra apologize within six hours of commenting on IPAC

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৩৩
Share: Save:

আইপ্যাককে ‘তোলাবাজ’ বলে মদন মিত্র বিতর্ক ‘অন’ করেছিলেন সোমবার দুপুরে। ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যেই তা ‘অফ’ করতে এক নয়, একাধিক চিঠি দিয়ে ক্ষমা চাইলেন দলের কাছে। মিত্র বাবুমশায়ের এই ডিগবাজির বিষয়-আশয় নিয়ে কোনও ‘অফিসিয়াল’ উত্তর মেলেনি ঠিকই। কিন্তু দলের অন্দরে নানা জনের নানা ব্যাখ্যা রয়েছে।

একটি বিষয়ে সকলেই একমত। তা হল, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভয়’। মদন সম্পর্কে মমতা এক বার বলেছিলেন, ‘‘ও খুব কালারফুল।’’ পাশাপাশিই, নেত্রী কিঞ্চিত সতর্ক করেও বলেন, ‘‘একটু একটু কালারফুল হও ঠিক আছে। কিন্তু বেশি কালারফুল হতে যেও না।’’ সেই মদনই সোমবার দুপুরে তৃণমূলের সঙ্গে জড়িত পেশাদার সংস্থা আইপ্যাককে ‘তোলাবাজ’ বলে তোপ দাগেন। শাসকদলে তোলপাড় শুরু হয়। রাতের মধ্যেই তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে চিঠি লিখে ক্ষমা চান ‘অনুতপ্ত’ মদন।

কেন এমন বিতর্কে জড়ালেন মদন? তিনি নিজে বা তৃণমূলের অন্য কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলতে নারাজ। তবে শাসকদলের একটি অংশের বক্তব্য, মদন গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আইপ্যাকের উপর রেগে রয়েছেন। এবং এই রেগে থাকার কেন্দ্রে রয়েছে কামারহাটিকেন্দ্রিক রাজনীতির কিছু বিষয়। মদন কামারহাটিরই বিধায়ক।

সম্প্রতি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েও তৃণমূলের পরামর্শদাতা সংস্থা সম্পর্কে নানা বিশেষণ-সহ কটাক্ষ করেছিলেন মদন। কিন্তু প্রাক্তন মন্ত্রী হঠাৎ কেন আইপ্যাককে নিশানা করছেন, তা উপস্থিত অনেকেরই বোধগম্য হয়নি। তবে কি কারও উস্কানি ছিল? দলে মদনের এক দীর্ঘ দিনের সতীর্থ একান্ত আলোচনায় বললেন, ‘‘মদনকে কেউ বলতে বলেনি। ও যা শুনেছে এ দিক-ওদিকে, সেটাই নিজের মতো করে বলে দিয়েছে।’’ একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘এ সব কথা এ ভাবে কেউ প্রকাশ্যে বলে!’’ ঘটনাচক্রে, যে নেতা এই কথা বলছেন, তিনিও আইপ্যাকের ভূমিকা নিয়ে যে খুব খুশি তা নয়।

তৃণমূলের একটি সূত্রে খবর, টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার যে কথা মদন একটি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, তা নিয়ে ক্ষুব্ধ আইপ্যাকও চুপচাপ বসে ছিল না। সংস্থারই এক কর্তা তৃণমূল রাজ্য নেতৃত্বের কাছে দৌত্য চালিয়েছিলেন, একটা কিছু বিহিত যেন করা হয়। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, তার পরেই মদনের কাছে বার্তা যায় এবং মদন ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখেন।

এখানেও একটি মোচড় রয়েছে। ঘটনা হল, মদন একটি চিঠি লেখেননি। লিখেছেন দু’টি চিঠি। প্রথমটি ইংরিজিতে। দ্বিতীয়টি বাংলায়। দু’টি চিঠিই প্রকাশ্যে রয়েছে। ইংরিজিতে যে চিঠি লিখেছিলেন মদন, তার বিষয়বস্তু ছিল— তাঁর কিছু কথা নিয়ে সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্তিকর প্রচার করছে। তিনি কিছু কথা বলেছেন ঠিকই। কিন্তু জ্বর ও অন্য অসুস্থতার কারণে গোলমাল হয়ে গিয়েছে। তিনি ও ভাবে বলতে চাননি। এই সব ব্যাখ্যার মধ্যে তাঁর ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিই লঘু হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দল আবার বার্তা দেয়, এ সব কথায় ‘চিঁড়ে ভিজবে না’। সেই বার্তা পেয়ে ইংরিজি থেকে বাংলায় ফেরেন মদন। স্পষ্ট লেখেন যে তিনি ক্ষমা চাইছেন। তাতে জ্বরজ্বালার আর উল্লেখ নেই। সংবাদমাধ্যমের দিকেও কোনও আঙুল তোলা নেই। ঘটনা হল, মদনের ওই বাংলা চিঠি সমাজমাধ্যমে ছড়াতে শুরু করেন আইপ্যাকের ছোঁয়ায় থাকা তৃণমূলের নেতারা।

আইপ্যাক নিয়ে তৃণমূলের অনেক প্রবীণ নেতারই ‘অ্যালার্জি’ রয়েছে। কিন্তু মদন যে ভাবে সরাসরি তোলাবাজির অভিযোগ করেছিলেন, তা নজিরবিহীন। মদন বলেছিলেন, ‘‘আমাদের পার্টিতে টাকাপয়সার লেনদেন ছিল না। এই একটা এজেন্সি আমাদের পার্টিতে ঢুকল। তারা এ সব শুরু করল।’’

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাংলায় ‘ধাক্কা’ খাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আইপ্যাককে নিয়োগ করেছিল তৃণমূল। তখন সংস্থার মাথায় ছিলেন প্রশান্ত কিশোর (পিকে)। ২০১৯-এর ‘ধাক্কা’ সামলে ২০২১ সালে তৃণমূল যে ভাবে জিতেছিল, তার নেপথ্যে অনেকেই আইপ্যাকের ভূমিকার কথা বলেন। মদন বুধবার দাবি করেছিলেন, সেই ভোটেই টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূলের প্রবীণ বিধায়কের বক্তব্য ছিল, ‘‘২০২১ সালের আগে এ সব শুরু হয়েছিল। টাকা নিয়েও নমিনেশন (মনোনয়ন) দেওয়া হয়নি। লোককে কাঁদতে দেখেছি!’’

আইপ্যাকের সমালোচনা করতে গিয়ে মদন এ-ও বলেছিলেন যে, ‘‘কামারহাটিতে আমাকে শেখানো হচ্ছে, সকালে উঠে কী ভাবে ব্রাশ করব! তার পর ডান দিকে তাকাব না বাঁ দিকে তাকাব।’’ মদনের দাবি ছিল, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ‘নামী-দামি ছেলে’র কাছে শুনেছেন, তাঁরা কেউ ২৫ লাখ, কেউ ৫০ লাখ দিয়েছেন। মদনের কথায়, ‘‘এই এজেন্সির ছেলেদের দিয়েছেন। তাঁরা কেউ নমিনেশন পাননি। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারছেন না। এত বড় বড় নাম তাঁদের।’’ মদনের দাবি, সেই সব লেনদেন পুরোটাই হয়েছিল নগদে। ফলে ‘প্রমাণ’ নেই।

সন্দেহ নেই, মদনের এ হেন মন্তব্যে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বও বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘২০২১ সালের ভোটের প্রচারে মমতাদিই বলেছিলেন, ২৯৪টি কেন্দ্রে তিনিই প্রার্থী। ফলে মদনদা যা বলেছেন, তা মমতাদিকে অসম্মান। ফলে ওঁর ডিগবাজি দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।’’ ওই নেতা নিশ্চিত, বিষয়টির মধ্যে মমতারও হস্তক্ষেপ ছিল। তৃণমূলে যে যতই বড় নেতা হোন, মমতাই দলে শেষ কথা। অন্য কেউ যে নন, তা মমতাও ইদানীং কালে বারংবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

তৃণমূলের তরফে আরও একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। সেই অংশের বক্তব্য, সম্প্রতি দলীয় শৃঙ্খলার বিষয় মমতা কোনও আপস করছেন না। হুমায়ুন কবীর থেকে নারায়ণ গোস্বামী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। মদনকেও রেয়াত করা হল না।

মদন-পর্বের নির্যাস: বেশি রঙিন হতে গিয়ে ছ’ঘণ্টার মধ্যেই ফিকে হয়ে গিয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী। মমতা বারণ করেছিলেন, ‘‘বেশি কালারফুল হতে যেও না।’’ মদনের বোধ হয় খেয়াল ছিল না!

অন্য বিষয়গুলি:

Madan Mitra Tmc Leader TMC MLA IPAC FirhadHakim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy