Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Rajib Banerjee

মানসিক দ্বন্দ্ব নাকি পরিচিত বৃত্তের বাইরে আসার অস্বস্তি, কেন কান্না রাজনীতিকদের

ঘটনাচক্রে, এই তিনজনই তৃণমূলের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। আর কে না জানে, তৃণমূলের জন্মই আবেগ থেকে! কে না জানে, তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীও চলেন আবেগে।

রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র খাঁ, শোভন চট্টোপাধ্যায়, এঁদের সকলকেই প্রকাশ্যে আবেগঘন হয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে।

রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র খাঁ, শোভন চট্টোপাধ্যায়, এঁদের সকলকেই প্রকাশ্যে আবেগঘন হয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২১ ২০:৫৮
Share: Save:

আড়াই বছর ধরে মনের মধ্যে পুষে রাখা ক্ষোভ। বৃহস্পতিবার তার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ক্ষোভের কথা বলতে গিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। সংবাদমাধ্যমের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেল তাঁকে। কথা বলতে গিয়ে বার বার গলা ধরে আসছিল। টেলিভিশনের পর্দায় দু’আঙুল চেপে তাঁর চোখ মোছার সেই দৃশ্যই গোটা রাজ্যে আপাতত আলোচনার বিষয়। তবে একা রাজীব নন। ভোটের ময়দানে লম্বাচওড়া হাঁক দিলেও প্রকাশ্যে রাজনীতিকদের এমন কান্নার দৃশ্য এই প্রথম চাক্ষুষ করলেন না বাংলার মানুষ। মাথার উপর থেকে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহের হাত সরে যাওয়ায় প্রকাশ্যে ছলো-ছলো চোখে আবেগপ্রবণ হতে দেখা গিয়েছে শোভন চট্টোপাধ্যায়কেও। অথবা কিছুদিন আগে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে স্ত্রী সুজাতা মণ্ডলকে বিবাহবিচ্ছেদের নোটিস পাঠানোর সময় হাপুসনয়নে কাঁদতে দেখা গিয়েছে বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ-কেও।

ঘটনাচক্রে, এই তিনজনই তৃণমূলের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। আর কে না জানে, তৃণমূলের জন্মই আবেগ থেকে! কে না জানে, তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীও চলেন আবেগে।

২০১৮ সালের গোড়ার দিকের কথা। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব নিয়ে তখন মুখরোচক গল্প চারিদিকে। তা নিয়ে দলনেত্রীর কাছেও ধমকও খেতে হয় শোভনকে। এক দিকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েন, অন্য দিকে খাদের কিনারায় রাজনৈতিক কেরিয়ার। তেমন পরিস্থিতিতেও বৈশাখীর হাত ছাড়তে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন শোভন। কিন্তু জেড প্লাস ক্যাটিগরির নিরাপত্তা উঠে যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যম যখম তাঁকে ছেঁকে ধরেছিল, তখনই আবেগের বাঁধ ভাঙে শোভনের। কান্নাভেজা গলায় বলেন, ‘‘মন থেকে বলছি, আমার মতো যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেন কাউকে না যেতে হয়।’’ এ নিয়ে আগেভাগে তাঁকে কিছু জানানোও হয়নি বলে আক্ষেপ করতে দেখা যায় তাঁকে। ২০১৯-এর অগস্টে মিল্লি আল আমিন কলেজ থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমের সামনে বৈশাখী যখন ঝরঝর করে কাঁদছেন, সেইসময় তাঁর পাশে বসা শোভনও অশ্রুসজল হয়ে পড়েন। ঠায় মাথা নীচু করে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। শেমেশ বোতল থেকে ঢোঁক গিলে জল খেয়ে স্বাভাবিক হতে দেখা যায় তাঁকে।

জনসাধারণের আবেগকে বশ করে ক্ষমতা দখল যাঁদের পেশা, তাঁদের আবেগের এমন বহিঃপ্রকাশ সমাজে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করে? মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমরা যখন কোনও জনপ্রতিনিধিকে দেখি, ধরে নিই সেই মানুষটি কখনও আবেগতাড়িত হতে পারেন না। তাঁর আবেগের বহিঃপ্রকাশ সবসময় লাগামযুক্ত হবে। আমার মনে হয়, এই ধরে নেওয়াটার মধ্যে কোথাও অসঙ্গতি আছে। একটু অন্য ভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক দায়িত্বে থাকলেও ওই ব্যক্তির উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হওয়া বা উচ্ছ্বসিত হওয়ার জায়গা থাকবে না, এমনটাই বা ধরে নেব কেন। কিন্তু এ রকম তো আমরা প্রায়শই দেখি যে, এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায় যাওয়ার সময় বিদায় অনুষ্ঠানে চোখের জল মুছছেন এক জন মানুষ। আমরা যদি এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কথা ভাবি, সেখানে একটা পরিবর্তনের আবহাওয়া বিদ্যমান, তা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই। এক দল থেকে অন্য দলে যাওয়া বা দীর্ঘ দিনের চেনা পরিবেশের বাইরে আসা। সে ক্ষেত্রে আবেগঘন হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।’’

প্রকাশ্যে আবেগঘন হয়ে পড়ার তালিকায় নবতম সংযোজন বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ তথা দলের যুবমোর্চার সভাপতি সৌমিত্র। বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে পদ্ম ফোটাতে বিজেপি নেতৃত্ব যখন তৎপর, তখন তাঁর ঘরের মানুষই বেঁকে বসেন। আচমকা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন সৌমিত্রর স্ত্রী সুজাতা। তাতে সর্বসমক্ষে ভেঙে পড়েন সৌমিত্র। সুজাতা জোড়াফুলের পতাকা হাতে তুলে নেওয়ার পরই সাংবাদিক বৈঠক করে স্ত্রী-কে বিবাহবন্ধন থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন সৌমিত্র। কাঁদতে কাঁদতে সংবাদমাধ্যমের সামনে স্ত্রী-র উদ্দেশে বলেন, ‘‘যে মানুষটা সুজাতা বলতে পাগল ছিল, সেই মানুষটার কথা না শুনে এই জায়গায় চলে এলে তুমি? আজ তোমাকে সম্পূর্ণভাবে খাঁ পদবি থেকে মুক্তি দিচ্ছি। সম্পূর্ণভাবে সৌমিত্র খাঁয়ের নাম থেকে মুক্তি দিচ্ছি তোমাকে। এবার থেকে নামের জায়গায় সুজাতা মণ্ডল লিখো। খাঁ পদবি আর ব্যবহার কোরো না। এটা আমার বংশ, আমার জাতির পরিচয়।’’

কিন্তু সৌমিত্রকে আবার বাকি রাজনীতিকদের সঙ্গে এক সারিতে রাখার পক্ষপাতী নন অনুত্তমা। তিনি বলেন, ‘‘সৌমিত্র খাঁ এবং তাঁর স্ত্রী-র বিষয়টি সম্পূর্ণ অন্য। সেখানে পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি জড়িত ছিল। কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে যদিও বা তাঁকে এক বন্ধনীতে রাখি, তাহলে বুঝতে হবে, যখনই তাঁরা তাঁদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন, তাঁদের খারাপ থাকার কথা বলেছেন, সেখানে পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জড়িত। আবেগের এমন বহিঃপ্রকাশ সাধারণ মানুষের যে হয় না, তা তো নয়! জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আমাদের একটা ভাবনা থাকে যে, তাঁদের সবকিছু যথাযথ হবে, যুক্তিযুক্ত হবে। তাঁদের আবেগে লাগাম থাকবে। আমাদের এই প্রত্যাশাটা সব সময়ে ঠিক না-ও হতে পারে। কারণ, তিনিও এক জন মানুষ। তাঁরও আবেগ লাগাম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সাময়িক ভাবে তিনিও বিহ্বল হয়ে পড়তে পারেন। আমরা হয়ত তারই বহিঃপ্রকাশ দেখছি। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা, তাতে আবেগের এই অনুপাতটা ভারী হয়ে আসছে। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তা-ই আমাদের সামনে বার বার প্রতিফলিত হচ্ছে।’’

রাজ্যের রাজনীতি প্রতিদিন যে দিকে যাচ্ছে, তাতে বিজেপি-র দাবি মানলে তৃণমূল থেকে আরও ওজনদার নেতা-মন্ত্রী তাদের দলে যাবেন। তখনও কি আবেগের বাঁধ ভাঙবে? ক্যামেরার সামনে দেখা যাবে হাউ-হাউ কান্না? হয়তো হ্যাঁ। হয়তো না। কে বলে রাজনীতিকরা আবেগবর্জিত হন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE