Advertisement
E-Paper

মরচে ধরেছে যন্ত্রে, সারাচ্ছেন ‘মেকানিক’

কোন রোষে লোকসভায় নিজের গড়েও ভোট হারাল তৃণমূল? কাটমানি-ক্ষোভও অব্যাহত। জেলায় জেলায় খোঁজগামছা আর ফুল নেওয়ার জন্য অনেক নেতা। কিন্তু সংগঠনে তো পতাকা ধরতে হয়, ফুল নয়।

প্রদীপ্তকান্তি ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৯ ০৩:৩৭
ব্যাটারিতে চলছে মাইক। শব্দ পরীক্ষা এক নেতার। —ফাইল চিত্র।

ব্যাটারিতে চলছে মাইক। শব্দ পরীক্ষা এক নেতার। —ফাইল চিত্র।

আয়োজনে ত্রুটি নেই। কিন্তু আচমকাই তেল ফুরোল!

মরচে পড়া যন্ত্রকে সক্রিয় করার দায়িত্ব পড়ছে শুভেন্দু অধিকারীর উপরে। তা পালনে কয়েক দিন আগে ঝাড়গ্রামের রবীন্দ্র পার্কে বৈঠক করছিলেন কাঁথির অধিকারী পরিবারের মেজ ছেলে। হঠাৎ মঞ্চ ‘নিস্তেল’!

মাঝপথেই তেল ফুরোল জেনারেটরের। নির্বাক মাইক্রোফোন। মিনিট দশেক পরে ব্যাটারির সাহায্যে তা চালু করা হলেও ছন্দ ফিরল না। বৈঠকে ইতি টেনে ফিরলেন নেতা-কর্মীরা। কিন্তু এক জন নেতা-কর্মীও খুঁজে পাওয়া গেল না, যিনি জেনারেটরে তেল রয়েছে কি না দেখে নেবেন!

বৈঠক ফেরত নেতা-কর্মীদের অনেকেই বলাবলি করলেন, ‘‘যন্ত্র আছে। কিন্তু যত্নের অভাবেই মরচে ধরছে। খুঁটিনাটি দেখার লোক কই। তা না হলে শুভেন্দুবাবুর বৈঠকে এমন হাল হয়!’’ তেল মাপার দায়িত্ব বর্তায় তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম শহর সভাপতি প্রশান্ত রায়ের উপরে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার কপালটাই মন্দ!’’

তৃণমূল নেতার যুক্তি যা-ই হোক কেন না, ঘটনাটি প্রতীকী! জঙ্গলমহলের উন্নয়ন নিয়ে যত জোরদার প্রচার হয়েছে, জনসমর্থনের নিরিখে সেই প্রচার ক্রমশই ক্ষয়িষ্ণু। পঞ্চায়েত ভোটে তার আভাস মিলেছিল। লোকসভায় জঙ্গলমহলের জলাশয়ে পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়েছে।

কেন এমন হল? তা নিয়ে অবশ্য নানা মত রয়েছে নয়াগ্রাম থেকে বেলপাহাড়ি কিংবা লালগড় থেকে বিনপুর কিংবা জামবনীর।

আবাস যোজনা, রেশনের প্রাপ্য, বিধবা-বার্ধক্য ভাতা-সহ সরকারি সুবিধা পেতে জুতোর সুকতলা ক্ষইছে দরিদ্র মানুষদের অনেকের। তবে একশো দিনের কাজ জোটে। কিন্তু জব কার্ড চাক্ষুষ করার সুযোগ মেলে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা থাকে ‘নেতা’র কব্জায়। সেই সুবাদে সংশ্লিষ্ট নেতার পকেটের ‘উন্নয়ন’ হয়েছে বলেই অভিযোগ। স্থানীয় নেতাদের সৌজন্যে সরকারের উন্নয়ন মাত্রাতেও ‘ঘাটতি’ হয়েছে বলে শোনা গিয়েছে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। কাঁকড়াঝোড় বাসস্ট্যান্ডে চপ কিনতে আসা জীবন বাস্কের মন্তব্য, ‘‘আপনারা তো কিনারে কিনারে এলেন, দেখলেন কিছু (তৃণমূল) করেছে? কিছু করলে তো ভোট পেতই। দেখি না মোদী কী করে!’’ ঘটনাচক্রে, কিছুটা দূরেই ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’র হিসেব দেওয়া রঙচঙে বোর্ড। উন্নয়নের সব কথা বোঝানো যায়নি বলে স্বীকার করছেন ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি বিরবাহা সরেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোন সরকার কী দিয়েছে, সবটা মানুষ বোঝেননি।’’

উপদলীয় কার্যকলাপ নিয়েও নেতা-কর্মীদের সতর্ক করেছিলেন দলীয় নেতৃত্ব। তাতে কাজ কতটা হয়েছে, ঝাড়গ্রামের ইতিউতি ঘুরলেও উত্তর অধরা। নয়াগ্রামের ফল খারাপের জন্য বিধানসভার অন্তর্গত গোপীবল্লভপুর এলাকার দিকেই ইঙ্গিত করলেন স্থানীয় নেতারা। তেমনই এক জনের বক্তব্য, ‘‘নয়াগ্রাম এলাকায় তো সমস্যা হয়নি। গোপীর (গোপীবল্লভপুর) জন্য হেরেছি।!’’ দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কয়েক জন নেতা-কর্মীর ‘হটলাইন’ রয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে বাকিদের পাত্তা না দেওয়ার অভিযোগ উঠছে।

যদিও দলীয় কার্যালয়ে বসে স্থানীয় নেতা অশোক মাহাতো বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ‘‘সব ঠিক আছে’’, কার্যালয়ে ভিড় জমানো অন্য নেতা-কর্মীরা সাফ বলে দিলেন, ঘটনা তা নয়। এক জন বলে উঠলেন, ‘‘সংগঠনে কিছুই ‘ওকে’ নয়। আগেই ভিত নড়েছে। ভোটে তা দেখা গেল।’’ আরেক জন বলছেন, ‘‘বড় নেতা মার খেলে রাস্তায় নামার জন্য নির্দেশ আসে। আমাদের মতো ছোটদের উপর আক্রমণ হলে কেউ দেখে না। এ ভাবে কত দিন চলবে!’’ যেমন ঝাড়গ্রামের পুনরুদ্ধারে আত্মবিশ্বাসী শুভেন্দু দলীয় নেতৃত্বকে আশ্বস্ত করছেন বলে শোনা গেলেও অনেকেই মনে করাচ্ছেন, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ধোনির ব্যাট আর ক্রিজের মধ্যে পাঁচ সেন্টিমিটারের মতো ফাঁক ছিল। তাঁদের মতে, ‘‘ধোনিরও আত্মবিশ্বাস ছিল। কিন্তু দু’রান হয়নি।’’ বরং ঝাড়গ্রামে বিজেপির সংগঠনে থাকা কর্মীর সংখ্যা কম হলেও সকলেই সক্রিয়। কিন্তু শাসক শিবিরে সেই সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হলেও অনেকে শুধু মাত্র মঞ্চ ‘আলো করে থাকেন। এক নেতা বলছেন, ‘‘গামছা আর ফুল নেওয়ার জন্য অনেক নেতা। কিন্তু সংগঠনে তো পতাকা ধরতে হয়, ফুল নয়।’’

পুরনো বাড়ি সংস্কার করে ঝাঁ চকচকে বাড়ি করেছে পদ্ম শিবির। দলের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে পর্দা রয়েছে জেলা বিজেপি সভাপতি সুখময় শতপথির ঘরে। বললেন, ‘‘যাদের (তৃণমূল) ঝাড়গ্রামে একটা ঠিকঠাক অফিস নেই, তারা আমাদের সঙ্গে পাল্লা দেবে!’’

কয়েক মাস ধরে ঝাড়গ্রামে কার্যালয় তৈরির জন্য জায়গা খুঁজেই চলেছে তৃণমূল। তাতে জনসংযোগে ঘাটতি হচ্ছে বলে মত দলীয় নেতৃত্বের একাংশের। তাঁরা বলছেন, ‘‘সিপিএমের সময়ে সমস্যা হলে লোকে পার্টি অফিস যেত। আমাদের তো কিছুই নেই। মানুষ সমস্যায় পড়লে কোথায় যাবেন!’’ আর শহরে তৃণমূলের ওয়ার্ড অফিস থাকলেও তা খোলা পাওয়া কষ্টসাধ্য। তৃণমূলের নেতাদের যুক্তি, ‘‘ঝাড়গ্রামে তো সাত মাস নির্বাচিত পুরবোর্ড নেই। তাই হয়তো বন্ধ। জনপ্রতিনিধির কাজ তো আর প্রশাসক করতে পারেন না।’’

এ হেন যন্ত্রের মেরামতি করতে গিয়ে অবশ্য যন্ত্রাংশকে বাতিল করছেন না ‘মেকানিক’। হাতের কাছে রেখেই মরচে ঝাড়ছেন বা বদল করছেন। কারণ, যন্ত্রাংশ ফেলে দিলে তা দিয়ে অন্য যন্ত্র মজবুত হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্টই। এক বিধায়ক বলছেন, ‘‘এত দিন যাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন, অথচ প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের থার্ড বেঞ্চে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাবা-বাছা করেই রাখতে হবে, না হলে বিজেপিতে চলে যেতে পারে।’’

TMC Jhargram Suvendu Adhikari Mamata Banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy