চার মাসের মধ্যেই আবার ব্যারাকপুরে পুলিশ কমিশনার পদে বদল। এ বার সিপি হলেন কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন গোয়েন্দাপ্রধান মুরলীধর। মুরলীধর এত দিন ব্যারাকপুরের ট্রেনিং সেন্টারে ছিলেন। গত বছরই তাঁকে লালবাজারের গোয়েন্দাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে ওই দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল। অন্য দিকে, এত দিন যিনি ব্যারাকপুরের সিপি ছিলেন, সেই অজয় ঠাকুরকে এ বার পাঠানো হল ডিআইজি (সিআইডি) করে।
২০১৯ সালের মে-জুন মাস থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ব্যারাকপুরের সিপি পদে এই নিয়ে সাত বার বদল হল। সুনীল চৌধুরী, তন্ময় রায়চৌধুরী, মনোজ বর্মা, অজয় ঠাকুর, অলোক রাজোরিয়ার পর আবার অজয় সিপি হন। এ বার ওই পদে এলেন মুরলীধর। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে থেকে যে রক্তঝরা পরিস্থিতি এবং প্রাণহানি শুরু হয়েছিল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে, তা অব্যাহত ছিল ভোটের পরেও। ভোট মেটার পরেই ব্যারাকপুরের সিপি পদ থেকে সুনীলকে সরিয়ে তন্ময়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার আগে তন্ময়ের অভিজ্ঞতা ছিল হুগলি শিল্পাঞ্চলে দুষ্কৃতী দমনের। কিন্তু পুলিশ মহলের একাংশের বক্তব্য, তন্ময় ব্যারাকপুরকে ‘সোজা’ করতে পারেননি! অচিরে তাঁকেও সরে যেতে হয়। এর পর জঙ্গলমহল এবং দার্জিলিঙের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আসা মনোজকে ব্যারাকপুর ‘ঠান্ডা’ করতে পাঠিয়েছিল নবান্ন। এই মনোজকেই আরজি কর-পরবর্তী পর্বে কলকাতার সিপি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পুলিশ মহলের একাংশের মত, ব্যারাকপুরের সিপি হিসাবে একমাত্র মনোজই খানিক সাফল্য পেয়েছিলেন। ব্যারাকপুর খানিক ‘ঠান্ডা’ হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে মনোজকে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্যারাকপুরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন অজয়। অজয়ের পর অলোক। চলতি বছরের শুরুতে নৈহাটিতে এক তৃণমূলকর্মী খুনের ঘটনা ঘটে। তা নিয়ে বিতর্কের আবহে অলোককে সরিয়ে দেয় নবান্ন। আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল অজয়কে।
কিন্তু চার মাসের মধ্যেই কেন আবার সিপি পদে বদল, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। পুলিশ মহলের একটি অংশের দাবি, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের বিষয়টি নজরে রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন। অজয়কে নিয়ে বিরোধীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। বড় অভিযোগ হল, তিনি ‘শাসকদলের ঘনিষ্ঠ’। ভোটের সময় বিরোধীদের এই অভিযোগ শুনে তাঁকে সিপি পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারে নির্বাচন কমিশন। প্রশাসনের এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মুরলীধরের ভাবমূর্তি ‘স্বচ্ছ’। তাঁর বিরুদ্ধে ‘শাসক-ঘনিষ্ঠ’ হওয়ার অভিযোগ সেই ভাবে তোলেন না বিরোধীরা।
কিন্তু মুরলীধরকেই কেন? পুলিশের একটি অংশের দাবি, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধানের পদে দীর্ঘ দিন থাকার পর নবান্ন প্রাথমিক ভাবে ভেবেছিল, তাঁকে হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার পদে বসাতে। কিন্তু আইপিএসদের শিবির সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের কারণে সেই সময়ে মুরলীধরকে হাওড়ার সিপি করা হয়নি। আরজি কর-পরবর্তী সময়ে মুরলীধরও ‘তুলনামূলক হালকা দায়িত্ব’ চাইছিলেন। সেই কারণে তাঁকে মাস সাতেকের জন্য ব্যারাকপুরের ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়েছিল। এ বার তাঁকে ‘গুরুদায়িত্ব’ দেওয়া হল। তা হল— ‘বাঁকা’ ব্যারাকপুরকে ‘সোজা’ করা।
যদিও কোনও দাবিরই আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেনি পুলিশের পক্ষ থেকে। এটিকে রুটিন বদলি বলেই জানিয়েছে রাজ্য পুলিশের সূত্র।
প্রসঙ্গত, গত বছর আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে যখন গোটা রাজ্য তোলপাড়, সেই সময়ে লালবাজারের গোয়েন্দাপ্রধানের পদে ছিলেন মুরলীধর। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে মহিলা চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের মামলার তদন্তভার প্রথমে কলকাতা পুলিশের হাতে ছিল। পুলিশি তদন্তের শুরু থেকে ঘটনা পরম্পরা এবং তদন্তের খুঁটিনাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুরলীধর। আরজি করের অকুস্থলেও একাধিক বার গিয়েছিলেন তিনি। নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে তাঁদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। ওই ঘটনার মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পর কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের সাংবাদিক বৈঠকের মধ্যেও কথা বলতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এমনকি, ধর্ষক এবং খুনি এক জনই— কলকাতা পুলিশের যে সব কর্তারা এই দাবি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই মুরলীধর অন্যতম। লালবাজারের ওই দাবি মানতে রাজি ছিলেন না আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা।
পরে আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআই-তদন্তে আরজি করে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় অভিযুক্ত হিসাবে এক জনের নামই উঠে আসে। এতে মুরলীধরের দাবি আরও মান্যতা পায়। তবে আন্দোলনকারীরা তৎকালীন পুলিশ কমিশনার-সহ একাধিক প্রশাসনিক আধিকারিকের অপসারণ চাইলেও কখনও মুরলীধরের অপসারণের দাবি তোলেননি।
গত বছর আরজি করের আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হতে না-হতেই কসবায় গুলি করে খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল তৃণমূল কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে। তবে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান কলকাতা পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুশান্ত। ওই ঘটনার পর কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। কসবার ঘটনার জন্য গোয়েন্দা ব্যর্থতার দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে, তার পরেই গোয়েন্দাপ্রধানের পদ থেকে মুরলীধরকে সরানো হয়েছিল। যদিও নবান্ন সূত্রের খবর ছিল, সেটি রুটিন বদলি।