শেষবেলার প্রস্তুতি। জগদ্দলে সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
ঘুড়িতে বিশ্বকর্মার মুখ। তাতে সিঁদুরের টিপ লাগিয়ে, ফুল-বেলপাতা ছুঁইয়ে দু’হাত দিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিলেন পুরোহিত। মর্ত্যে পুজো হচ্ছে। কিন্তু বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের দুর্দশার খবর কি পৌঁছচ্ছে স্বর্গে? বিশ্বকর্মার মুখ আঁকা ঘুড়ি যদি সেই বার্তা কিছুটা পৌঁছতে পারে! ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের নিক্কো কারখানার শ্রমিকরা এমনটাই ভেবেছিলেন দোকান থেকে ঘুড়ি কিনে আনার পরে। তাই ঘুড়ি উড়িয়েই এ বার রুগ্ণ শিল্পাঞ্চলে সৃষ্টির দেবতার আবাহন হল।
রাজ্যের অন্যতম বড় শিল্পাঞ্চল ব্যারাকপুর-কল্যাণীতে এক সময়ে দুর্গাপুজোর থেকেও বড় উৎসব ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। বরাহনগর থেকে কল্যাণী পর্যন্ত গঙ্গার পার বরাবর দুই জেলার শিল্পাঞ্চলের হাজার দুয়েক কারখানা আলোর মালায় সাজত। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বড় কারখানাগুলির ভিতরের কাজকর্ম দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন বাইরের লোকেরা। কিন্তু ভিতরে ঢোকার অনুমতি মিলত শুধু বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। ওই দিন কারখানার দরজা খোলা থাকত সকলের জন্য। আর ঢালাও খাওয়া দাওয়া। বড় কারখানাগুলোতে কর্মীদের পরিবারের শিশুদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান এবং উপহারের ব্যবস্থাও থাকত। মহালক্ষ্মী কটন মিল, বেঙ্গল এনামেল, জেনসন অ্যান্ড নিকেলসন, গৌরীপুর জুটমিল বিখ্যাত ছিল বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য। ওই এলাকায় সে দিন সকলের বাড়িতে অরন্ধন চলত। কারখানার এক এক বিভাগে পুজো। মালিকের পুজোয় জাঁকজমক আর জৌলুস একটু বেশি। শ্রমিকদের হয়তো একটু কম। কিন্তু দুই পুজো মিলে যেত প্রসাদ বিলির সময়ে।
এক সময়ে মহালক্ষ্মী কটন মিলের সুপারভাইজার ছিলেন অবনী সেন। এখন বয়স হয়েছে, অনেক স্মৃতি ঝাপসা। তবু থেমে থেমে বললেন, ‘‘এই শিল্পাঞ্চলের বিশ্বকর্মা পুজো নিয়ে ইতিহাস লেখা যায়। মনে আছে, আগে মেলা বসত গঙ্গার ধারে। কাঠের নাগরদোলা, মাটির পুতুল, মুড়কি, তেলে ভাজা, জিবে গজা- কত কিছু মিলত! ওই দিন মেশিনগুলোতে তেল-সিঁদুর লাগিয়ে পুজো হত। সন্ধ্যায় জলসা নয় থিয়েটার। শ্রমিকদের পরিবার থেকেও যাত্রা হত। এখন সব স্মৃতি।’’ শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা বলেন, ‘‘আগে শিল্পাঞ্চলে বিশ্বকর্মা পুজো হত কারখানায়। এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে অসংখ্য রিকশা আর অটো স্ট্যান্ডে পুজোর ছড়াছড়ি।’’
ব্যারাকপুর ছাড়িয়ে কল্যাণীতেও কারখানাগুলোয় বিশ্বকর্মা পুজোর জৌলুস কমে গিয়েছে। বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেখানেও। কিছু ধুঁকছে। পুজো হচ্ছে কম-বেশি। শ্রমিক পরিবারগুলো ভিড় করেছে পুজো মণ্ডপে। কোথাও খিচুড়ি আবার কোথাও চাঁদা তুলে ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন মেনু প্রসাদের পরে দুপুরের খাওয়ায়।
গঙ্গার ধার বরাবর ব্যারাকপুর-কল্যাণী শিল্প-তালুকে এখন কলকারখানার চেহারা বড়ই রুগ্ণ। বড় বাজেটের বিশ্বকর্মা পুজো তাই এখন আর বিশেষ নজরে পড়ে না। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ২১টি চটকলের প্রায় সব ক’টিই শ্রমিক-মালিক বিরোধ এবং বকেয়া পাওনার সমস্যায় জর্জরিত। পুজো হচ্ছে ঠিকই। ধুনুচি নাচ, প্রদীপ জ্বালিয়ে পুরোহিত আরতি করছেন। কিন্তু প্রদীপের নীচে অন্ধকারটা গভীর। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের অন্যতম বড় গৌরীপুর কুলি লাইনে এখনও প্রায় হাজার শ্রমিক বাস করেন। যাঁদের পরিবার নিয়ে মোট সংখ্যাটা দু’হাজারের কাছাকাছি। গৌরীপুর চটকল ছাড়াও, গৌরীপুর থার্মাল পাওয়ার, নৈহাটির রঙ কারখানা জেনসন নিকেলসন, কন্টেনার্স অ্যান্ড ক্যাপ্স-এর শ্রমিকেরা থাকেন এই কুলি লাইনে। এই কারখানাগুলি অবশ্য বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বকেয়া প্রায় কিছুই পাননি শ্রমিকেরা। তবু আশা রাখেন, কারখানা যদি কখনও খোলে, অথবা অন্য কোনও কারখানাও যদি হয় বন্ধ কারখানার জমিতে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy