Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আদালত বদলেই বিচারে দেরি, মনে করেন মমতা

মহারাষ্ট্রে গণধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও পশ্চিমবঙ্গে কেন দেরি হচ্ছে, তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার কালীঘাটে নিজের বাড়িতে লোকসভা ভোটের জন্য দলীয় ইস্তাহার প্রকাশ উপলক্ষে সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই এই প্রসঙ্গ টানেন তিনি।

দলের নির্বাচনী ইস্তাহার হাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার কালীঘাটের বাড়িতে। ছবি: প্রদীপ আদক।

দলের নির্বাচনী ইস্তাহার হাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার কালীঘাটের বাড়িতে। ছবি: প্রদীপ আদক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০৩:০৪
Share: Save:

মহারাষ্ট্রে গণধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও পশ্চিমবঙ্গে কেন দেরি হচ্ছে, তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

শনিবার কালীঘাটে নিজের বাড়িতে লোকসভা ভোটের জন্য দলীয় ইস্তাহার প্রকাশ উপলক্ষে সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই এই প্রসঙ্গ টানেন তিনি। বলেন, “একটা কোর্ট থেকে মামলা আর একটা কোর্টে নিয়ে গেলে তাতে সময় লাগবেই। এটা তো পরিষ্কার করে বোঝা দরকার।”

শুক্রবার মুম্বইয়ের শক্তি মিলস গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত চার জনের যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করেছে মুম্বইয়ের আদালত। সময় লেগেছে সাত মাস একুশ দিন। ওই শক্তি মিলস চত্বরেই আরও একটি গণধর্ষণের ঘটনায় চার অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করতে আদালত সময় নিয়েছে ছ’মাস পঁচিশ দিন। এই মামলাটির সাজা ঘোষণা হবে সোমবার। অর্থাৎ এক বছরেরও অনেক কম সময়ে দু’-দু’টি গণধর্ষণ মামলায় রায় ঘোষণা করেছে মহারাষ্ট্রের আদালত। সেই নিরিখে এ রাজ্যে পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি এবং মধ্যমগ্রামের মতো ঘটনায় বছর গড়িয়ে গেলেও কেন অভিযুক্তরা অধরা থাকে, কেন মামলা চলতেই থাকে সেই প্রশ্ন উঠছে।

এ দিনের সাংবাদিক বৈঠকের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল এই প্রসঙ্গ। মমতা বলেন, “কেউ কেউ বলছেন, মহারাষ্ট্র যা পারে, বাংলা তা পারে না। আজ একটা কাগজ (পড়ুন আনন্দবাজার) কোনও একটা উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছে।” এর পরেই তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন কেন এখানে মামলায় দেরি হচ্ছে। তাঁর কথায়, “আমরাও ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলা শুরু করেছিলাম। কিন্তু তার পরে মেয়েটির পরিবারের লোকেরা অন্য কোর্টে মামলা নিয়ে যায়! রাষ্ট্রপতি ভবনে যায়, দিল্লি যায়, চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। সে যদি তিনটে কোর্টে যায়, তাতে সময় লাগে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, অনেক ক্ষেত্রেই মামলায় একাধিক আদালত জড়িয়ে পড়ছে। তার ফলে বিচারে দেরি হচ্ছে। তবে মমতা মনে করান, “প্রতিটি মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে।”

মুখ্যমন্ত্রীর কথা থেকে স্পষ্ট, নাম না করলেও তিনি মূলত কামদুনি মামলার কথাই বলতে চেয়েছেন। তিনি নিজে ওই মামলায় দ্রুততম গতিতে সাজা পাইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। কামদুনি মামলায় আট অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়েছে। দশ মাস বাদে চার্জ গঠন হয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। মামলাটি প্রথমে চলছিল বারাসত কোর্টে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মামলাটি সরিয়ে নেওয়ার আর্জি জানায় অভিযুক্তরাই। সেই মতো মামলাটি এখন কলকাতার নগর দায়রা আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে চলছে। নিহত ছাত্রীর পরিবারের লোকজন ও গ্রামবাসীরা বরং চেয়েছিলেন, মামলাটি বারাসত কোর্টেই চলুক। এ নিয়ে আন্দোলনেও নেমেছিলেন তাঁরা।

কামদুনি ছাড়া গণধর্ষণের অন্য মামলাগুলিতে কেন দেরি হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর কথায় এ দিন সে ভাবে ছিল না। দু’বছর আগের পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় এখনও দু’জন অধরা। বাকি অভিযুক্তদের চার্জ গঠন হয়ে মামলা চলছে। বর্ধমানের কাটোয়ায় দু’বছর আগের গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা এখনও শেষ হয়নি। গত অক্টোবরের মধ্যমগ্রাম মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব চলছে। এই তিনটি মামলাই চলছে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, ‘‘আদালত কবে রায় শোনাবে তা রাজ্যের হাতে নেই।”

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, “মুম্বইতে ছ’মাসের মধ্যে রায় হল। এখানে বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনায় দু’আড়াই বছর হয়ে গেল। অনেক ক্ষেত্রে এখনও তদন্তই শেষ হয়নি। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) কেমন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট করবেন বোঝাই যাচ্ছে!”

যদিও এই জমানাতেই এ রাজ্যে দ্রুত বিচারের দৃষ্টান্ত অবশ্যই রয়েছে। গত বছরই বোলপুর, বালুরঘাট এবং মালদহে তিনটি ধর্ষণের মামলায় যথাক্রমে কুড়ি মাস, সাত মাস

এবং চব্বিশ দিনের মাথায় সাজা ঘোষণা হয়েছে। তিনটি মামলারই রায় দিয়েছে জেলা আদালত। বোলপুরের মামলায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে চার্জ গঠনের পরে ওই আদালতটিই অতিরিক্ত জেলা জজের আদালতে রূপান্তরিত হয়েছিল।

মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এ দিন বালুরঘাট এবং মালদহের মামলায় দ্রুত চার্জ গঠনের কথা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তিনি এ দিন অভিযোগ করেন যে, অর্থাভাবেই এ রাজ্যে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের সংখ্যা কমছে। ‘‘আগে কেন্দ্র এ রাজ্যে প্রায় ১৬০টা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালাত। আমরা ক্ষমতায় আসার পরে কেন্দ্র এই কোর্ট চালানোর টাকা বন্ধ করে দেয়। তার পরে রাজ্য নিজের টাকায় ৭০-৮০টা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালাচ্ছে।” এর পাশাপাশি রাজ্যে ৪৫টি মহিলা আদালত রয়েছে। ২৬টি মহিলা থানা গড়া হয়েছে। শুক্রবার একই দাবি করেছিলেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও।

তবে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, কোনও রাজ্যকেই এখন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালানোর খরচ দেয় না কেন্দ্র। প্রথম কিছু বছরের জন্যই ওই সাহায্য চালু ছিল। প্রায় বারো বছর আগে, ২০০২ সালে সুপ্রিম কোর্ট ঠিক করে খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি-প্রতারণার মতো গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের ক্ষেত্রে দোষীরা যাতে দ্রুত শাস্তি পায়, তার জন্য জেলায় জেলায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট খোলা হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রত্যেক রাজ্যকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। আইনজীবীরা জানান ২০১২ সালে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টগুলি কেমন কাজ করছে, সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রককে তা খতিয়ে দেখতে বলে। সেই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থান, ওড়িশায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের সংখ্যা ধারাবাহিক ভাবে বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো কয়েকটি রাজ্যে সেই সংখ্যাটা কমেছে।

কলকাতার নগর দায়রা আদালতে এখন মাত্র দু’টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট রয়েছে। তার সঙ্গে একটি অতিরিক্ত জেলা দায়রা আদালত। আইনজীবীরা জানান, পার্ক স্ট্রিট-কামদুনির মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার সঙ্গে আরও অনেক মামলার বিচারই এই আদালতে হয়। ফলে ইচ্ছে থাকলেও মুম্বইয়ের মতো টানা বিচারপ্রক্রিয়া চালানো এখানে সম্ভব হয় না।

শুধু তাই নয়। যে ক’টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট রয়েছে রাজ্যে, তার মধ্যেও রয়েছে হাজারো সমস্যা। এ রাজ্যের বিভিন্ন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে কর্মরত আইনজীবীদের দাবি, এই ধরনের আদালতে কর্মীর সংখ্যা কম। কোনও আদালতের কাজ চালানোর জন্য বিচারক ছাড়াও স্টেনোগ্রাফার এবং করণিক প্রয়োজন। সাক্ষীদের বয়ান এবং অন্যান্য নথি লেখার কাজ এঁরাই করেন। এই সব কর্মীর অভাবে মামলার কাজে দেরি হচ্ছে।

অনুবাদকের অভাবেও অনেক সময় মামলা দীর্ঘায়িত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অভিযুক্তরা অনেকে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা জানেন না। তাঁদের জন্য সব নথিপত্র বাংলায় অনুবাদ করতে হয়। অথচ শুধুমাত্র কলকাতা হাইকোর্টেই সরকারি অনুবাদক রয়েছেন। কামদুনি মামলার সরকারি আইনজীবী অনিন্দ্য রাউত যেমন বলছিলেন, ওই মামলাতেও এই ভাষা সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টে কর্মীসংখ্যা কম থাকায় অনুবাদক পেতে দেরি হয়েছে বলে অনিন্দ্যবাবুর দাবি।

তার সঙ্গে রয়েছে কর্মসংস্কৃতির সমস্যা। অনেকে মনে করেন, সার্বিক ভাবেই বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে একটা ঢিলেঢালা ভাব রয়েছে। রাজ্যের বিচারব্যবস্থাও তার বাইরে নয়। এ রাজ্যের আদালতে কেউ মারা গেলেই ছুটি হয়ে যায়। আইনজীবীদের একাংশই স্বীকার করছেন, এমনিতেই বিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়া এতে আরও পিছিয়ে যায়। অথচ সুপ্রিম কোর্ট-সহ একাধিক রাজ্যে এমন ক্ষেত্রে শুধু নীরবতা পালন করে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর রীতি রয়েছে। তাতে কাজ বন্ধ হয় না।

তবে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সামগ্রিক ভাবে বিচারব্যবস্থায় দেরি, আদালতের অপ্রতুলতা নিয়ে যা বলেছেন, তা সকলেই এক কথায় মেনে নিচ্ছেন। “লক্ষ লক্ষ কেস পড়ে রয়েছে”, বলে মন্তব্য করে বিচারব্যবস্থা সংশোধনের কথা তুলেছেন মমতা। বাংলা বনাম মহারাষ্ট্রের তুলনায় না গিয়ে বলেছেন, “আমি মহারাষ্ট্রকে ভালবাসি। মহারাষ্ট্রের মানুষকে ভালবাসি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mamata rape
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE