বাড়ি ফিরল অরূপ রায়চৌধুরীর দেহ। দমদমে। ছবি: শৌভিক দে
নেপালের সাম্প্রতিকতম দুর্ঘটনায় মৃত আরও দু’জন বাঙালি পর্যটক ইন্দ্রনীল ঘোষ ও সুনীল সেনের দেহ উদ্ধার হল আজ। যুবকল্যাণ দফতর সূত্রের খবর, তাঁদের দেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। আগামী কাল কলকাতায় পৌঁছনোর কথা। অন্য এক পর্যটক তথাগত জানার খোঁজ মেলেনি এ দিনও। যদিও নেপাল সরকারের তরফে উদ্ধারকাজ শেষ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বেলুড়ের একটি পর্বতারোহী ক্লাব থেকে নেপালের অন্নপূর্ণা অঞ্চলে ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন শেওড়াফুলির বাসিন্দা ইন্দ্রনীল ঘোষ ও ডোমজুড়ের সুনীল সেন। দলে আরও পাঁচ সদস্য ছিলেন। নেপালে তাঁদের ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল ‘নেপাল অল্টারনেটিভ ট্রেক্স অ্যান্ড এক্সপিডিশনস’ নামে একটি সংস্থা। মঙ্গলবার মানাং জেলার ফু গ্রাম থেকে শিয়াং গ্রামে আসার পথে তুষার ঝড়ের মুখে পড়ে দলটি।
বাড়ির ছেলে ট্রেকিংয়ে যাওয়ার পর থেকেই দুশ্চিন্তায় ছিল ঘোষ পরিবার। বুধবার তুষার ঝড়ে ছেলের নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে ঘুম উড়ে গিয়েছিল সবার। ঠায় টিভির সামনে বসে থাকা, কখনও নেপালে, কখনও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছিল। জিজ্ঞাস্য একটাই। ইন্দ্রনীল ঘোষ ওরফে রাজার কোনও খোঁজ মিলল কি না। ইন্দ্রনীলের দেহ উদ্ধারের খবর পৌঁছতেই সোমবার যাবতীয় জল্পনার অবসান হয়ে গেল ।
খবর ছড়িয়ে পড়তেই শেওড়াফুলির পুরভবনের কাছে ঘোষবাড়িতেই শুধু নয়, গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পেশায় সব্জির আড়তদার ছিলেন ইন্দ্রনীল। ইন্দ্রনীলের জেঠতুতো দাদা সৌমেন ঘোষ জানান, এ দিনই তাঁদের দুই আত্মীয় বিকাশ ঘোষ এবং বিশ্বনাথ চক্রবর্তী নেপালে গিয়েছেন। সঙ্গে গিয়েছেন নিখোঁজ অভিযাত্রী তথাগত জানার দাদা সিদ্ধার্থ জানাও।
হাওড়ার ডোমজুড়ে হালদারপাড়ার বাসিন্দা সুনীল সেনেরও মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে আজ। সুনীলবাবু দু’বছর আগে ব্যাঙ্ক থেকে অবসর নেন। তাঁর দিদি চৈতি সেন বলেন, “ভাইয়ের দুই বন্ধু সৌম্য মুখোপাধ্যায় এবং তপন ঘোষ সোমবার ভাইয়ের খোঁজে নেপাল রওনা হয়েছেন। তবে তাঁদের কাছ থেকে এখনও কোনও খবর পাইনি। খুবই উৎকণ্ঠায় রয়েছি।”
আজ সন্ধেয় কলকাতা পৌঁছেছে চার দিন আগে উদ্ধার হওয়া অরূপ রায়চৌধুরীর দেহ। দশমীর দিন বন্ধুদের সঙ্গে হই হই করে ট্রেকিংয়ে বেরিয়েছিলেন বছর চল্লিশের অরূপ। দুর্গম পথ নয়, পরিচিত পর্যটন-পথ মুক্তিনাথের উদ্দেশে। তখন কেউ ভাবতেও পারেননি, কফিনবন্দি হয়ে ফিরতে হবে তাঁকে। সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ অরূপের দেহ বাড়িতে এসে পৌঁছতেই পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড় ভেঙে পড়ে। ভিড়ের চাপে অরূপের দেহ ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় পরিবার। ভিতরে কান্নায় ভেঙে পড়েন অরূপের স্ত্রী ঝিমলি। আড়াই বছরের মেয়ে অর্ণা কিছু না বুঝেও বাকরুদ্ধ। কথা হারিয়েছেন অরূপের ৯০ বছরের বৃদ্ধা মা-ও।
ঘরের বাইরের ছবিটাও একই রকম প্রায়। দমদমের ইস্টমল রোডের বাসিন্দা ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র। সব কাজে এগিয়ে আসার জন্য এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। এই মৃত্যুতে তাই চোখে জল পাড়া-প্রতিবেশী-বন্ধু বান্ধব সবারই।
ওই ট্রেকিংয়েই অরূপের সঙ্গী সুব্রত দত্ত জানালেন, ফেরার সময় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল অরূপের। তাই ঘোড়ার পিঠে চড়ে নামছিলেন তিনি। তুষার ঝড় শুরু হতেই চোখের আড়াল হয়ে যান অরূপ। একটি ভিয়েতনামি দলের সাহায্যে সুব্রত ফিরতে পারলেও, খুঁজে পাননি অরূপকে।
আজ অরূপের দেহ কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছনোর সময় উপস্থিত ছিলেন পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু, যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, দমদম এলাকার সাংসদ সৌগত রায়, যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা উজ্জ্বল রায়। সরকারের তরফে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে অরূপের পরিবারকে।
নেপাল প্রশাসন সূত্রের খবর, এ পর্যন্ত ৩০০ জনকে উদ্ধার করা গিয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৪০ পেরিয়েছে। নিখোঁজ আরও ৪০ জন। তবে তাঁদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। প্রায় পাঁচ-ছ’ফুট পুরু বরফে ঢেকে গিয়েছে ওই এলাকা। “ট্রেকিং এজেন্সি’জ অ্যাসোসিয়েশন অব নেপাল”-এর তরফে সরকারি ভাবে উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
পর্যটন মন্ত্রী দীপক অমাত্য নেপালের এই দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করে জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে যাতে এমন না ঘটে, তার জন্য সরকারি ভাবে পদক্ষেপ করা হচ্ছে। “এই দুর্যোগের জন্য শুধু আবহাওয়াকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। আমাদের পর্যটন ব্যবস্থায় গলদ থেকে গিয়েছে। পর্যটকদের ও নেপালের গাইড-শেরপাদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।” বলেছেন দীপক অমাত্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy