Advertisement
০১ মে ২০২৪
গুড়িয়া হত্যা-মামলা

উদয়চাঁদ-শ্যামলের যাবজ্জীবনে স্বস্তি গ্রামে

দু’বছর আগে ‘সিল’ হয়ে গিয়েছে হোম। আবাসিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের অন্যান্য হোমে। তবু, দু’বছর ধরে গুড়াপের মিল্কি-খাজুরদহ এলাকার ‘দুলাল স্মৃতি সংসদ’ হোমের তৎকালীন সম্পাদক উদয়চাঁদ কুমার এবং তার সহযোগী শ্যামল ঘোষের কীর্তিকলাপ মুখে-মুখে ঘুরেছে গ্রামবাসীদের। এক সময়ে গ্রামবাসীদের কাছে যারা ছিল ‘ভালমানুষ’, গুড়িয়া-কাণ্ড সামনে আসার পরেই খুলে যায় তাদের মুখোশ।

প্রকাশ পাল ও তাপস ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৩
Share: Save:

দু’বছর আগে ‘সিল’ হয়ে গিয়েছে হোম।

আবাসিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের অন্যান্য হোমে।

তবু, দু’বছর ধরে গুড়াপের মিল্কি-খাজুরদহ এলাকার ‘দুলাল স্মৃতি সংসদ’ হোমের তৎকালীন সম্পাদক উদয়চাঁদ কুমার এবং তার সহযোগী শ্যামল ঘোষের কীর্তিকলাপ মুখে-মুখে ঘুরেছে গ্রামবাসীদের। এক সময়ে গ্রামবাসীদের কাছে যারা ছিল ‘ভালমানুষ’, গুড়িয়া-কাণ্ড সামনে আসার পরেই খুলে যায় তাদের মুখোশ। গুড়িয়া-হত্যা মামলায় মঙ্গলবার চুঁচুড়া আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক (ফার্স্ট কোর্ট) অরূপ বসু উদয়চাঁদ এবং শ্যামলকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়ায় খুশি তাঁদের অনেকেই। খুশি হোমের প্রাক্তন কর্মীরাও। যাঁরা দীর্ঘদিন মুখ বুজে ছিলেন, তাঁরা এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।

মিল্কি গ্রামের এক মুদি-দোকানি যেমন বলেন, “হোমের ভিতরে যে কী কুকীর্তি হত তা কোনও দিন বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারিনি। গুড়িয়া-কাণ্ড সামনে আসার পরে তদন্তে যা বেরোল, তা খুবই অন্যায়। অসহায় মহিলাদের উপরে এমন অত্যাচার মানা যায় না। সমাজে ওদের কোনও ঠাঁই নেই। সঠিক সাজা হয়েছে।” প্রায় একই সুরে ওই হোমের তৎকালীন সহ-সম্পাদিকা সোনালি চক্রবর্তীও বলেন, “আদালতের রায়ে আমি খুশি। যখ‌নই গুড়িয়া বা ওঁর মতো অসহায় মেয়েদের উপরে অত্যাচারের কথা ভাবি, শিউরে উঠি।’’ এ দিনের রায় শুনে খুশি হোমের তদানীন্তন সুপার সভাপতি বুলবুল চৌধুরী।

গুড়িয়া-কাণ্ড সামনে আসার পরে সমাজকল্যাণ দফতরের ভূমিকাও সমালোচনার মুখে পড়েছিল। তাদের নজরদারির অভাবেই সেখানে মেয়েদের উপর অত্যাচার দিনের পর দিন বাড়তে থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। এ দিন আদালতের রায় জানার পরে জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক প্রফুল্লকুমার দে বলেন, ‘‘ওই হোমে যা অনিয়ম এবং অন্যায় হয়েছে, তাতে উপযুক্ত সাজা হয়েছে ওই দু’জনের। ওই ঘটনার পর থেকে জেলার সব হোমে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’’

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, হোমটি প্রায় পাঁচ দশকের পুরনো। তৈরি করেছিলেন উদয়চাঁদের বাবা অজিত কুমার। তিনি আমৃত্যু হোমের ডিরেক্টর ছিলেন। ২০০৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে উদয়চাঁদ হোমের সম্পাদক হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত ওই হোমে তিনটি বিভাগ ছিল শিশুভবন, মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের আবাস এবং ভবঘুরে মহিলাদের আবাস। গুড়িয়ার ঠাঁই হয়েছিল তৃতীয় বিভাগে। সেই সময়ে হোমে সব মিলিয়ে শতাধিক আবাসিক ছিলেন। কর্মী ছিলেন অন্তত ২৫ জন।

তদন্তকারী সিআইডি অফিসারদের দাবি, গুড়িয়ার মৃত্যু হয় ২০১২ সা‌লের ২৮ জুন। ওই দিন বেলা সাড়ে ৪টে নাগাদ শ্যামল হোমে ঢোকে। গুড়িয়া থাকতেন হোমের দোতলায় ২৩ নম্বর ঘরে। ধর্ষণে বাধা দেওয়াতেই শ্যামল গুড়িয়ার উপর খেপে যায়। রান্নাঘর থেকে জ্বালানির জন্য রাখা বাঁশের লাঠি এনে পেটাতে শুরু করে বছর বত্রিশের ওই যুবতীকে। উদয়চাঁদও তার সঙ্গে যোগ দেয় গুড়িয়াকে অবাধ্যতার শাস্তি দিতে। ওই মারেই মৃত্যু হয় গুড়িয়ার। অন্য আবাসিকদের দিয়ে দেহটি টেনে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নীচে রেখে দিতে বাধ্য করা হয়। ঘর থেকে রক্তের দাগ মুছে ফেলা হয় তাঁদের দিয়েই। টানা দু’দিন দেহ সিঁড়ির নীচে পড়ে থাকার পরে ২ জুলাই সকালে দেহটি হোমের পিছনে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে পুঁতে দেওয়া হয়। ঘটনাটি জানাজানি হয় ১১ জুলাই। বিজেপির জেলা নেতা স্বপন পালের দাবি, ওই দিন হোমের এক আবাসিকের রহস্যজনক মৃত্যুর কথা শুনে তাঁরা এসডিও (সদর)-কে স্মারকলিপি দেন। জেলা প্রশাসন তদন্তে নামতেই ঝুলি থেকে বেড়াল বেড়িয়ে আসে।

প্রথমে তদন্তকারী অফিসারদের কাছে এবং পরে আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে হোমের কর্মী এবং আবাসিকদের অনেকেই জানান, কী ভাবে দিনের পর দিন মেয়েদের উপর অত্যাচার করত উদয়-শ্যামল জুটি। ধর্ষণে বাধা দিলে জুটত বেধড়ক মার। সে ভাবে খেতে দেওয়া হত না। হোমের কর্তা হওয়ার দরুণ এলাকায় উদয়চাঁদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। শ্যামল হোমে আসতে শুরু করে ২০০৬-০৭ সাল নাগাদ। হোমের সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত না থেকেও উদয়চাঁদের বদান্যতায় শ্যামল সেখানকার সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল।

ওই হোমের কর্মীদের কেউ কেউ উদয়চাঁদ এবং শ্যামলের আরও ‘কঠিন সাজা’ আশা করেছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদেরই এক জন বলেন, “বিকেলে‌র পর থেকে নিয়মিতই মেয়েদের উপর অত্যাচার শুরু হত।’’ আর এক কর্মীর কথায়, ‘‘গুড়িয়ার আগেও অনেক আবাসিককে মেরে দেহ লোপাট করে দেওয়া হয়েছে। গুড়িয়ার মৃত্যু রহস্য উদঘাটন না হলে আরও অনেক গুড়িয়াই হয়তো ও ভাবে মারা যেত।’’ আসামীদের বাড়ির লোকজন তাঁদের শাসাচ্ছেন বলে অভিযোগও তুলেছেন কেউ কেউ। তবে, উদয়চাঁদ ও শ্যামলের পরিবারের লোকজন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE