অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
২২ এপ্রিল, ২০১৩। গাড়িতে বসেই শুনেছিলাম, যেতে হবে পাক অধিকৃত কাশ্মীর। রিয়াজ (সারদার কাশ্মীরের এজেন্ট) নামে এক জন আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে। সুদীপ্ত সেন আমাকে বললেন, “পাক অধিকৃত কাশ্মীরের পাকিস্তান হাই কমিশন অফিসে গিয়ে বলব যে, আমি একটি উর্দু ও বাংলা খবরের কাগজ বের করি, যা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের উন্নয়নের পথ দেখায়। তা হলেই ওঁরা আমাদের আশ্রয় দেবেন।” এই সব বলার পরই আমার মোবাইল ফোন দু’টি কেড়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন সুদীপ্ত।
কিন্তু কী ভাবে এলাম পাক অধিকৃত কাশ্মীর যাওয়ার এই পথে? তা জানতে গেলে শুরু করতে হবে আরও এগারো দিন আগে, ১১ এপ্রিল থেকে।
চেয়ারম্যান সুদীপ্ত সেন আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, জরুরি মিটিং আছে। কিছু চিঠিপত্রও লিখতে হবে। সে জন্য আমি যেন ১২ তারিখ দিল্লি চলে আসি। সেই ফোন রাখার কিছু ক্ষণ পরে তিনি ফের ফোন করে আমাকে ১১ তারিখ রাঁচি আসতে বলেন। সেই মতো ১১ তারিখ আমি রাঁচির বিমান ধরি। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য প্লেন রাঁচিতে নামতে পারল না। আমি কলকাতায় ফিরে এলাম। পরের দিন অর্থাৎ ১২ এপ্রিল সাড়ে ১১টার ফ্লাইটে দিল্লি যাই। সে জন্য সুদীপ্ত দু’জনকে দিয়ে আমার বাড়িতে টিকিটও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সুদীপ্ত আর ওঁর ড্রাইভার অরবিন্দ চৌহান আগে থেকেই দিল্লিতে ছিলেন। আমি যাওয়ার পরে আমি আর সুদীপ্ত বিকাশপুরীর কোহিনুর গেস্টহাউসে উঠলাম। অরবিন্দ রইলেন তাঁর দিল্লির বাড়িতে। পর দিন, ১৩ এপ্রিল আমরা সবাই মিলে দেহরাদূন যাই। সুদীপ্তর নির্দেশ অনুযায়ী, দেহরাদূনের একটি সাইবার কাফে থেকেই আমি কলকাতায় সারদার কয়েক জন কর্তাকে ই-মেল করি। পয়লা বৈশাখ অর্থাৎ, ১৫ এপ্রিল আমরা হরিদ্বারে পুজো দেব বলে ঠিক করেছিলাম। তাই ১৪ এপ্রিল গভীর রাতে আমরা হরিদ্বার রওনা হয়ে যাই। ১৫ এপ্রিল সকালে পুজো দেওয়ার পর ঠিক হয়, আমরা করবেট ন্যাশনাল পার্ক যাব। সেই রাতেই আমরা করবেট পার্কে পৌঁছই। ওই সময় সুদীপ্ত বলেন, “সারদার সব পদস্থ অফিসারকে নিয়ে করবেট পার্কে একটা মিটিং করব। তাই আরও এক দিন থাকা প্রয়োজন।” কিন্তু ঘটনা হল, সুদীপ্তর ডাকে সাড়া দিয়ে সারদার কেউই করবেট পার্কে আসেননি। উল্টে তাঁরা সুদীপ্তকে দ্রুত কলকাতায় ফিরে আসতে বলেছিলেন। ১৬ এপ্রিল আমরা করবেট পার্ক থেকে বেরিয়ে যাই। তার আগে সারদার কয়েক জনকে আরও কিছু চিঠি লেখা হয়। আমার ল্যাপটপ থেকেই ওই চিঠি লেখা হয়েছিল। ১৬ এপ্রিল রাতে আমরা হলদোয়ানির একটি গেস্ট হাউসে উঠলাম।
ভোর তিনটে নাগাদ হঠাৎ ঘরের দরজায় আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে দেখি, সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে। বললেন, “আমরা এখনই নেপাল যাব। তাড়াতাড়ি তৈরি হও।” ভোর চারটে নাগাদ আমরা বেরোলাম। ওই দিন, মানে ১৭ এপ্রিল আমরা নেপালের ঘোড়াঘোড়ি এলাকায় অরবিন্দ চৌহানের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আমার দু’টো মোবাইল ফোনের কোনওটাই কাজ করছিল না। মা-কে ফোন করব বলে সুদীপ্তকে বললাম পাবলিক ফোন বুথে নিয়ে যেতে। পরের দিন, ১৮ এপ্রিল সকালে একটি বুথ থেকেই মায়ের সঙ্গে কথা হল। মা-ই জানালেন, কলকাতায় ‘প্রভাত বার্তা’র কর্মীরা মিডল্যান্ড পার্কে সারদার অফিসে হামলা করেছে। পুলিশ গিয়ে মিডল্যান্ড পার্কের অফিস সিল করে দিয়েছে। আমি যেন কলকাতায় ফিরে আসি। আমিও সুদীপ্তকে বললাম, ‘‘চলুন, আমরা ভারতে ফিরে যাই।’’ কিন্তু উনি বললেন, এর পর কাঠমান্ডুতে আরও ১৫ দিন থাকতে চান। ওখানেও অরবিন্দের এক আত্মীয়ের বাড়ি রয়েছে। কিন্তু আমি এক রকম জোর করেই তাঁকে ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।
১৮ এপ্রিল সন্ধেবেলা আমরা উত্তরপ্রদেশের রুদ্রপুরে এসে উদয় হোটেলে উঠলাম। ওই দিনই কলকাতা থেকে সারদার আইন বিষয়ক কর্তা নরেশ ভালোড়িয়ার ফোন এল। সুদীপ্ত বললেন, নরেশ তাঁকে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী আপনাকে গ্রেফতার করতে বলেছেন। আপনি যে উত্তরপ্রদেশে রয়েছেন, সে খবরও পুলিশের কাছে আছে।” এর পরেই উত্তরপ্রদেশ ছাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সুদীপ্ত। সময় নষ্ট না করে আমরা ১৮ এপ্রিল মাঝরাতেই আবার বেরিয়ে গেলাম। ১৯ এপ্রিল সকাল সাতটা নাগাদ পৌঁছলাম হরিয়ানার সোনীপতে। আমি কিন্তু তখন কলকাতা ফেরার জন্য ব্যস্ত। সোনীপতের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে রাতের ফ্লাইটে আমার একার জন্য কলকাতার টিকিটও কিনে ফেললাম। বিমান ধরব বলে বেলা ১টা নাগাদ আমরা দিল্লির দিকে রওনা হলাম। কিন্তু আমাকে দিল্লিতে যেতে না-দিয়ে মাঝপথে গাড়ি ঘুরিয়ে সুদীপ্ত চণ্ডীগড় হয়ে পঞ্জাবের কিরাতপুর চলে গেলেন। তার মধ্যে আমার মায়ের সঙ্গে আবার কথা বলার জন্য আমার উপর চাপ দিতেও শুরু করলেন। ওঁর জোরাজুরিতেই আমি মা-কে ফোন করলাম। মা ফোন ধরতে সুদীপ্ত তাঁকে সটান বলে দিলেন, “এখন কলকাতায় ফেরা আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। ”
কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। ওই রাতে আমার ল্যাপটপ থেকে অনলাইনে কলকাতার টিকিট কাটার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ইন্টারনেট ডঙ্গল-টা কাজ করছিল না। তখন আমি হোটেলে রিসেপশনে টিকিটের বিষয়টি বলি। ওঁরা জানান, পরের দিন সকালের আগে কিছু করা সম্ভব নয়। আমি কাঁদতে কাঁদতে সুদীপ্ত সেনকে বলি, “আমাকে কলকাতায় ফিরে যেতে দিন।” উনি আমাকে বলেন, “তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখ। আমি যা করছি, ঠিকই করছি।”
২০ এপ্রিল সকালে আমরা কিরাতপুর থেকে কুলুতে আসি। আসার পথে বিলাসপুর থেকে আমি চণ্ডীগড়-কলকাতা রুটে ২১ তারিখের একটি ফ্লাইটের টিকিট বুক করি। ২১শে সকালে আমি যখন সুদীপ্তকে আমায় চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করছি, তখন তিনি বললেন, “আমরা রোটাং পাস হয়ে লাদাখ যাব।” কিন্তু ওই দিন মানালি পর্যন্ত এসে দেখলাম, বরফে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওই পথে আর এগোনো সম্ভব নয়। ফলে সুদীপ্ত ঠিক করলেন, তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে পাঠানকোট হয়ে জম্মু চলে যাবেন। শেষ পর্যন্ত আমরা অবশ্য সে দিন জম্মু পেরিয়ে উধমপুর গিয়ে একটা হোটেলে উঠি।
২২ এপ্রিল সকালে আমরা শ্রীনগরের দিকে রওনা হয়ে যাই। তখনই গাড়িতে বসে শুনলাম, শ্রীনগর থেকে পাক অধিকৃত-কাশ্মীর যাবেন বলে ঠিক করেছেন সুদীপ্ত আর অরবিন্দ। রিয়াজ নামে সারদার এক কর্মীর বাড়ি কাশ্মীরে। অরবিন্দ জানান, “রিয়াজ মাঝেমধ্যেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে যায়। ও-ই সব ব্যবস্থা করে দেবে।” সুদীপ্ত তখনই বলেন, “পাকিস্তান হাইকমিশন অফিসে গিয়ে বলব যে, আমি একটি উর্দু ও বাংলা খবরের কাগজ বের করি, যা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের উন্নয়নের পথ দেখায়। তা হলেই ওঁরা আমাদের আশ্রয় দেবেন।” এর পরই আমার দু’টি মোবাইল কেড়ে নেন সুদীপ্ত। আমি যাতে কোনও ভাবেই পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারি, সে জন্যই এই ব্যবস্থা জানিয়ে দেন তিনি।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের দিকে যাব বলেই ২২ এপ্রিল রাতে আমরা সোনমার্গে পৌঁছলাম। এই সময় আমি হোটেলের কাছে একটি ধাবায় এক জনের কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে নিয়ে মাকে এক বার ফোন করেছিলাম। তার পর হোটেলে গিয়ে শুনলাম, সুদীপ্ত লাদাখ হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তখন হোটেলের এক কর্মীর কাছ থেকে একটা ফোন নিয়ে আমি আবার মা এবং আমার এক উকিল বন্ধুকে ফোন করি। আমি কী অবস্থায় আছি, সেটা ওঁদের বলি। সুদীপ্তর পরিকল্পনার কথাও জানাই। ওঁরা বলেন, কাল সকালেই পুলিশ হোটেলে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করবে। এবং পরের দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল সকাল আটটা নাগাদ সোনমার্গ থানার পুলিশ হোটেলে এসে আমাদের আটক করল।
উপসংহার
২০১৩-র ৫ নভেম্বর তারিখে আগাগোড়া নিজের হাতে ইংরেজিতে এই বয়ান লিখেছিলেন দেবযানী। এই বয়ান তদন্তকারী অফিসারেরা দেখিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেনকে। বয়ানের অন্যান্য অংশ পুরোপুরি ঠিক আছে বলে জানালেও পাক-অধিকৃত যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না বলেই দাবি করেন সারদা-কর্তা। নিজের হাতে ইংরেজিতে তিনি লেখেন, “২২ এপ্রিল ঠিক করেছিলাম যে সোনমার্গ থেকে জম্মু ফিরে সেখান থেকে বিমান ধরে কলকাতা চলে আসব। সে কথা অরবিন্দ চৌহানকে বলেওছিলাম আমি।”
সুদীপ্ত সেনের এই বয়ান কতটা ঠিক, তা নিয়ে অবশ্য গোয়েন্দাদের সন্দেহ আছে। কারণ, গত দেড় বছরে তিনি একাধিক বার বয়ান পাল্টেছেন। দিয়েছেন পরস্পর-বিরোধী জবানবন্দি।
অন্য দিকে, দেবযানীর বিবৃতি যদি ঠিক হয়, তা হলে পালানোর গন্তব্য হিসেবে কেন পাক অধিকৃত কাশ্মীরকেই বেছে নিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন, সেই প্রশ্নও ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। তাঁরা জানার চেষ্টা করছেন, এর পিছনে তৃণমূলের কোনও নেতার যোগ ছিল কিনা। কাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে সারদা-কর্তাকে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে পাঠানো হচ্ছিল? সেখানে সুদীপ্ত -দেবযানীর নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল? নাকি দু’জনের জন্যই অপেক্ষা করছিল অন্য কোনও ভবিতব্য? সারদা-র দুই মাথা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে সব চেয়ে বেশি লাভবান কারা হতেন এ সবই এখন সিবিআই গোয়েন্দাদের আতসকাচের নীচে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy