ন্যানো বিদায়ের ছ’বছর কেটে গেলেও শিল্প-বিরোধী তকমা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ। বিশেষত উৎপাদন শিল্পের প্রসঙ্গে বঙ্গের ওই প্রতিকূল ভাবমূর্তি যে আদৌ মোছেনি, রাজ্য সরকার আয়োজিত শিল্প সম্মেলনের আলোচনাসভায় তারই প্রমাণ মিলল। বৃহস্পতিবার ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর সভাতেই উঠে এল পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন শিল্পের মলিন ছবি। যে মালিন্য ঢাকতে পারেনি রাজ্য সরকারের পেশ করা ঝলমলে তথ্য-পরিসংখ্যান।
এ দিন শিল্প সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদন শিল্পের বেহাল দশা নিয়ে সরব হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি অ্যান্ড প্রোমোশনের (শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীন) সচিব অমিতাভ কান্ত। তাঁর পর্যবেক্ষণ, এ রাজ্যে শিল্পবৃদ্ধির যে হার দেখানো হচ্ছে, তার ঔজ্জল্য মূলত ছোট-মাঝারি শিল্পের দৌলতে। বড় শিল্পের অভাব রয়েই গিয়েছে। “পশ্চিমবঙ্গ উৎপাদন শিল্পের গুরুত্বই বুঝতে পারছে না! অথচ এই শিল্পে অন্যতম কাণ্ডারী হওয়ার সম্ভাবনা এ রাজ্যেরই আছে। কিন্তু রাজ্য নিজেই জানে না নিজের সম্ভাবনা।” মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় সচিব।
দু’দিন ধরে বিনিয়োগ আকর্ষণের এই মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘শিল্প-সাফল্যের’ খতিয়ান তুলে ধরছেন রাজ্যের শিল্প ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তাঁর খতিয়ান বলছে, রাজ্যে শিল্পবৃদ্ধির হার ৮.৭৪%, এবং উৎপাদন শিল্পে বৃদ্ধির হার ৫.৪৫%। এর পিছনে বড় শিল্পের অবদান বিশেষ নেই এমন তত্ত্ব মানতে অমিতবাবু নারাজ। এ দিন কেন্দ্রীয় সচিবের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কিছুটা ঘুরিয়ে অমিতবাবুর উত্তর, “বড় শিল্পের জন্যই ছোট-মাঝারি শিল্প উৎপাদন করে। অর্থাৎ, তারা সহযোগী শিল্প হিসেবে কাজ করে। তাই বলা যাবে না যে, বড় শিল্প নেই।”
অন্য দিকে অমিতবাবুর পরিসংখ্যানকে নস্যাৎ না-করেও অমিতাভ কান্তের দাবি, উৎপাদন শিল্পে ১৫% বৃদ্ধির হার আয়ত্ত করা না গেলে উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস উৎপাদন শিল্প। সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও উৎপাদন শিল্পে নজর বাড়ানোয় জোর দিয়েছেন। এক ধাপ এগিয়ে তিনি এ-ও বলেন, শতাংশের হিসেব আসল ছবিটা তুলে ধরে না।
উৎপাদন শিল্পে এ রাজ্যের এমন দুর্দশার ব্যাখ্যা কী? শিল্পমহলের দাবি, জমি প্রশ্নে রাজ্যের অবস্থানই উৎপাদন শিল্পে লগ্নি-খরার অন্যতম কারণ। রাজ্যে বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে জমি পাওয়া কঠিন। রাজ্যের শিল্পতালুকেও তেমন সম্ভাবনা বিশেষ নেই। উৎপাদন শিল্পে লগ্নির বড় সুযোগ হাতছাড়া করে যার খেসারত দিতে হয়েছে। ন্যানো তো গিয়েইছে, লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো-র মতো সংস্থাও বড় জমি না-পেয়ে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প করতে পারেনি। এ দিকে রাজ্য সরকার আগেই জানিয়ে দিয়েছে, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না। অথচ একাধিক মালিকানার জট কাটিয়ে শিল্পসংস্থার পক্ষে সরাসরি জমি কেনা বিপুল সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এমতাবস্থায়ও শিল্পমহলের প্রশ্ন, জমি-নীতি না-পাল্টালে পশ্চিমবঙ্গ বড় শিল্পে বিনিয়োগ কী ভাবে টানবে? একই কথা আরও কড়া চেহারায় পেশ করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র। “সরকার হাত গুটিয়ে বেসরকারি মাফিয়াদের হাতে জমির ব্যাপারটা ছেড়ে দিচ্ছে! কিন্তু আমাদের নীতি হল, জমির ক্ষেত্রে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতেই হবে।” বলেন সূর্যবাবু। তাঁর কটাক্ষ, “এই আমলে এ রাজ্যে শিল্প আসা কঠিন। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) উৎপাদন শিল্প (সিঙ্গুর) তাড়িয়েছিলেন। সরকার থেকে ওঁকে না-তাড়ালে উৎপাদন শিল্পে আর কিছু হওয়ার নয়।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জমি সংক্রান্ত সংশয়-অভিযোগ ফুৎকারে ওড়াচ্ছেন। সিঙ্গাপুর সফরের পরে যেমন বলেছেন, কিংবা বণিকসভার অনুষ্ঠান শেষে বা সভার বক্তৃতায় যেমন বলেন, শিল্প সম্মেলনের মঞ্চেও তাঁর একই রকম প্রত্যয়ী ঘোষণা: জমি কোনও সমস্যা নয়, সরকারের জমি ব্যাঙ্ক রয়েছে। যদিও সেই ব্যাঙ্কের জমি কী ভাবে কার কাজে আসবে, তা নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন শিল্পের বিবর্ণ চিত্র কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যানেও প্রকট। কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রক সূত্রের দাবি: লগ্নির প্রস্তাব যতই থাকুক না কেন, প্রকল্প রূপায়ণের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ পিছোচ্ছে। রাজ্যে শিল্পমন্ত্রীর পদে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জায়গায় অমিত মিত্র আসার পরও অবস্থা বিশেষ বদলায়নি। মমতার সরকার রাজ্যের শাসনক্ষমতায় এসেছে ২০১১-র মে-তে। ২০১২-য় রাজ্যে সাকুল্যে ৩১২ কোটি টাকার প্রকল্প রূপায়ণ হয়েছিল, যা কিনা আগের বছরের তুলনায় ৮৫% কম। শিল্পমহলের আশঙ্কা, উৎপাদন শিল্পের হাল এমন থাকলে রাজ্যে কর্মসংস্থান তলানিতে ঠেকবে। এক শিল্পকর্তার আক্ষেপ, “হিন্দমোটর, শালিমার পেন্টসের মতো পুরোনো সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল! রাজ্যের শো-পিস হলদিয়া পেট্রোকেমও খোলেনি। নতুন কর্মসংস্থান তো দূরের কথা, মানুষের চাকরি রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে।”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন জানিয়েছেন, এই শিল্প সম্মেলনে লগ্নির যা প্রস্তাব এসেছে, তাতে এক কোটি কমর্সংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। শুনে শিল্পমহলের যা সার্বিক প্রতিক্রিয়া, তার মোদ্দা কথা: বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারি প্রতিশ্রুতির কোনও সামঞ্জস্য নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy