সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে (বাঁদিক থেকে) প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বৃন্দা কারাট ও নিরুপম সেন। ছবি: সুমন বল্লভ।
পঞ্চাশ বছর আগে দল তৈরি হওয়ার পর থেকেই পথ দেখিয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ। আন্দোলন গড়ে তোলা থেকে সরকার পরিচালনা সবেতেই বঙ্গ ব্রিগেড থেকেছে সিপিএমের কাছে পথ প্রদর্শক। এখন সেই পথ প্রদর্শকের নিজের পথই বেসামাল! বাংলায় তাই দুর্বল সংগঠনই যে তাঁদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে, রাজ্য সম্মেলনের সূচনা করে সেই উদ্বেগ গোপন করলেন না প্রকাশ কারাট। এ রাজ্যে ভাঙা সংগঠনকে আবার খাড়া করাই তাঁদের মূল লক্ষ্য বলে বুঝিয়ে দিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক।
কলকাতা জেলা দলের সদর দফতর প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে সোমবার থেকে শুরু হল সিপিএমের ২৪তম রাজ্য সম্মেলন। দলের পতাকা উত্তোলন করে এবং শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে সকালে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন কারাট। প্রথমে প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এবং পরে সম্মেলনের ভিতরে প্রতিনিধিদের সামনে কারাট যা বলেছেন, তা থেকে সংগঠনের বিচ্যুতি সামলানোর চেষ্টাই স্পষ্ট। বাইরে কারাট বলেন, রাজ্যে তৃণমূলের স্বৈরাচারী শাসন চলছে। তার সঙ্গে নতুন ‘ভাইরাস’ হিসাবে এসেছে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ। তৃণমূল ও বিজেপি, এই দুই শক্তির মোকাবিলা করতে গেলে সংগঠনের হাল ফেরানো জরুরি। কারাটের কথায়, “সম্মেলনে আমরা গভীর আত্মসমীক্ষা করব। ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করতে না পারলে তা থেকে শিক্ষা নেওয়া যাবে না। আর শিক্ষা নেওয়া না গেলে সামনে এগোনো যাবে না। স্বৈরাচারী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে আমাদের।”
কারাট যেমন এ রাজ্যে সংগঠনে ধসের কথা বলেছেন, তেমনই বিকালে দলের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু সম্মেলনের খসড়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করে এই অবস্থার মধ্যেও ‘নিষ্ক্রিয়তা’র সমস্যা মেনে নিয়েছেন। কোণঠাসা অবস্থার মধ্যেও দলের কর্মীদের একাংশের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা যে দূর করা যাচ্ছে না, তার জন্য আক্ষেপ করেছেন রাজ্য সম্পাদক। প্রশ্ন তুলেছেন, ‘অবাঞ্ছিত’দের সম্পর্ক কি সব ক্ষেত্রে দূর হয়েছে? আত্মসমালোচনার প্রশ্নেও দলে থেকে-যাওয়া জড়তা নিয়েও সরব হয়েছেন। সূত্রের খবর, বিমানবাবু বলেছেন আত্মসমালোচনা করতে হবে নির্মম ভাবে। দলের নেতা-কর্মীরা কেউ যদি মনে করেন, তা হলে পরিষ্কার বলতে হবে ‘বিমান বসু ব্যর্থ’! অন্য কেউ ব্যর্থ মনে হলেও একই রকম খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, বিমানবাবু এ দিন যখন ওই রিপোর্ট পেশ করছেন, সেই সময়ে সম্মেলনে ছিলেন না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
কারাটের পরেই এ দিন শহিদ-তর্পণে অংশ নেন সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাট, এস আর পিল্লাই, মানিক সরকার, বিমানবাবু, বুদ্ধবাবু, নিরুপম সেন, সূর্যকান্ত মিশ্রের মতো দলের পলিটব্যুরো সদস্যেরা। সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন ৮০০-রও বেশি প্রতিনিধি। বিমানবাবুর রাজনৈতিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের কাজের মূল্যায়নের উপরে একটি পৃথক দলিল নিয়েও আলোচনা হবে সম্মেলনে। নতুন রাজ্য কমিটি গঠন করে শুক্রবার শেষ হবে সম্মেলন। সূত্রের খবর, সম্মেলনের পয়লা অধিবেশনে প্রতিনিধিদের সামনে খোলাখুলিই সংগঠনের হাল নিয়ে চিন্তার কথা বলেছেন কারাট। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, আরএসএস কী করছে, সিপিএমের রেডারে তা ধরা পড়ছে না! এটা আরও বড় বিপদ। সর্বত্র সঙ্ঘ পরিবার নিজেদের শিকড় ছড়াচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে দীর্ঘ দিন বামেরা এই বিপদ ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও এখন উঠে আসছে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার।
দলের সাধারণ সম্পাদকের মতে, দেশে বামেরা বরাবরই বাংলা, কেরল ও ত্রিপুরার উপর নির্ভরশীল। ত্রিপুরায় অনেক দিন সরকার চালিয়েও ভোট বাড়ছে। কেরলে সরকার থেকে চলে যেতে হলেও দলের জনভিত্তি একেবারে ভেঙে পড়েনি। অথচ ৩৪ বছর সরকার চালানোর পরে বাংলায় সিপিএমের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন চলছে। সংসদে বামেদের দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিই আসতেন বাংলা থেকে। এখন কোথায় সব! দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে পাল্টা লড়াইয়ের জন্য সংগঠনকে কিছুটা চাঙ্গা করা ছাড়া যে উপায় নেই, বুঝিয়ে দেন কারাট। আগামী কয়েক দিনে এ বার এর উপরে মতামত জানাবেন প্রতিনিধিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy