Advertisement
E-Paper

কালীঘাটের ভাণ্ডারের স্বর্ণমুদ্রার সন্ধান বিলেতে

কালীঘাটের ধারে আদিগঙ্গার তীরে নৌকা বাঁধতে গিয়ে চমকে গিয়েছিলেন এক মাঝি। নোঙরে যেন ভারী ধাতব কিছু লাগল! প্রচলিত কাহিনি মতে, নিছক কৌতূহলেই নদীর পাড়ের মাটি খুঁড়তে গিয়ে তাঁর হাতে ঠেকল পিতলের একটা ঘট। মুখটা আঁটা। সেটা খুলতেই চমকে গেলেন তিনি। ঘট ভরা স্বর্ণমুদ্রা। সংখ্যায় দু’শোর সামান্য বেশি। দীর্ঘদিন ভিজে মাটির তলায় পড়ে থাকায় ঘটের মধ্যে জল চুঁইয়ে ঢোকে। তাতে মুদ্রাগুলির উপরে একটা কালো প্রলেপ চেপে বসেছিল।

অলখ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৪ ০৩:৩৫
স্বর্ণমুদ্রা ভাণ্ডারের কয়েকটি নিদর্শন। —নিজস্ব চিত্র।

স্বর্ণমুদ্রা ভাণ্ডারের কয়েকটি নিদর্শন। —নিজস্ব চিত্র।

কালীঘাটের ধারে আদিগঙ্গার তীরে নৌকা বাঁধতে গিয়ে চমকে গিয়েছিলেন এক মাঝি। নোঙরে যেন ভারী ধাতব কিছু লাগল! প্রচলিত কাহিনি মতে, নিছক কৌতূহলেই নদীর পাড়ের মাটি খুঁড়তে গিয়ে তাঁর হাতে ঠেকল পিতলের একটা ঘট। মুখটা আঁটা। সেটা খুলতেই চমকে গেলেন তিনি। ঘট ভরা স্বর্ণমুদ্রা। সংখ্যায় দু’শোর সামান্য বেশি। দীর্ঘদিন ভিজে মাটির তলায় পড়ে থাকায় ঘটের মধ্যে জল চুঁইয়ে ঢোকে। তাতে মুদ্রাগুলির উপরে একটা কালো প্রলেপ চেপে বসেছিল।

সেটা ১৭৮৩ সাল। জাঁকিয়ে রাজত্ব করছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কালীঘাট এলাকা ছিল তাদেরই মুন্সি মহারাজা বাহাদুর নবকৃষ্ণ দেবের। নবকৃষ্ণ ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খুব কাছের লোক। একের পর এক খেতাব পাচ্ছেন তখন। সে কালের গোবিন্দপুরের যে অঞ্চলে তাঁরা থাকতেন, সেই এলাকাটিও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ গড়ার জন্য কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করেন সুতানুটিতে। শোভাবাজারে তাঁদের সেই রাজবাড়ি তখন গমগম করছে। প্রচলিত কাহিনি মতে, পুরস্কারের আশায় সেই ঘট ভরা স্বর্ণমুদ্রাগুলি মাঝি সেখানে গিয়ে তুলে দিলেন নবকৃষ্ণের হাতে। নবকৃষ্ণও এক দিন বেশ সকালে তাঁর ঝালরদার পাল্কি চেপে চললেন খোদ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাড়ি। সেই ঘট উপহার দিলেন হেস্টিংসকে।

অবাক এবং উত্তেজিত হেস্টিংসও ওই স্বর্ণমুদ্রার সাহায্যে তাঁর কর্তাদের খুশি করার সুযোগ ছাড়েননি। তবে প্রায় ৩০টি স্বর্ণমুদ্রা নিজের কাছে রেখে দেন। ১৭২টি জাহাজে চাপিয়ে পাঠালেন কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের কাছে। সঙ্গে আবেদন, এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি যেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু দু’বছর পরে হেস্টিংস লন্ডনে পৌঁছে শুনলেন, মাত্র ২৪টি ব্রিটিশ মিউজিয়মে রয়েছে। বাকিগুলি গলিয়ে ফেলার হুকুম দিয়েছে কোর্ট অব ডিরেক্টর্স। হেস্টিংস ভেঙে পড়েছিলেন। বাকি স্বর্ণমুদ্রাগুলির আর সন্ধানও পাননি।

তার কিছু দিন পরে জানা যায়, ওই স্বর্ণমুদ্রাগুলি গুপ্ত আমলের। এর মধ্যে রয়েছে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত থেকে বিষ্ণুগুপ্ত পর্যন্ত বিভিন্ন গুপ্ত রাজাদের স্বর্ণমুদ্রা। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা অধিকর্তা গৌতম সেনগুপ্ত বলেন, “কালীঘাট এলাকা খুব প্রাচীন কাল থেকেই পরিচিত ধর্মস্থান ছিল। লোক যাতায়াত করত। তাই সেখানে নদীর ধারে সেই মুদ্রাগুলি ঘটে ভরে পুঁতে রেখে দেওয়া খুবই সম্ভব।”

উনিশ শতকের বিশের দশকে প্রাচ্যতত্ত্ববিদ উইলিয়াম মার্সডেন আবিষ্কার করেন, কোম্পানির বড় কর্তাদের নির্দেশ সত্ত্বেও সত্যি সত্যিই বাকি স্বর্ণমুদ্রাগুলি গলিয়ে ফেলা হয়নি। কিন্তু মাত্র কয়েকটির সন্ধান তিনি করতে পেরেছিলেন। বাকিগুলির খোঁজ মিলছিল না। সেই স্বর্ণমুদ্রাগুলির সন্ধান করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অধ্যাপিকা সুস্মিতা বসু মজুমদার। ‘কালীঘাট হোর্ড: দ্য ফার্স্ট গুপ্ত হোর্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’ নামে তাঁর বইটি প্রকাশিত হবে আজ, বুধবার।

সুস্মিতা জানান, ওই স্বর্ণমুদ্রাগুলির মধ্যে ২০টি পাঠানো হয়েছিল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় উইলিয়াম হান্টারের ব্যক্তিগত সংগ্রহালয়ে। এখন সেখানে রয়েছে ১৯টি। একটি পাঠানো হয়েছে প্যারিসের একটি সংগ্রহশালায়। কিছু গিয়েছিল কেম্ব্রিজের ফিৎজউইলিয়াম সংগ্রহশালায়, কিছু যায় অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান সংগ্রহশালাতে। কিছু ছিল ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছেও। তাঁরা মারা যাওয়ার পরে তাঁদের পরিবার থেকে আবার অনেক হাত ঘুরে বেশ কয়েকটি মুদ্রা ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই এসে পৌঁছেছে।

এই ভাবে কালীঘাটের সেই ঘটের ১২৮টি মুদ্রার সন্ধান এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে। সুস্মিতা সেই সব মুদ্রা শনাক্ত করে প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ইতিহাস অর্থাৎ কোথা থেকে কী ভাবে কোথায় সেগুলি গিয়েছে, তার বিবরণ লিখেছেন তাঁর বইয়ে। কিন্তু কী করে বোঝা গিয়েছে, এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি সেই কালীঘাটের ঘটেরই? সুস্মিতা জানান, মুদ্রার উপরের কালো প্রলেপ এবং তাদের ইতিহাস থেকেই বোঝা যায়, মুদ্রাগুলি ওই ঘটেরই। এই মুদ্রাভাণ্ডার থেকে গুপ্তদের অর্থনৈতিক ইতিহাসেরও সন্ধান করেছেন সুস্মিতা।

সুস্মিতা বলেন, “এই ধরনের কালো প্রলেপ পাওয়া গিয়েছে বাংলার শাসক শশাঙ্ক ও জয়নাগের মুদ্রার গা থেকেও। তাই মনে হয়, ওই মুদ্রাগুলিও এই ঘটেই ছিল। সেই মুদ্রাগুলিও রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়মের সংগ্রহে।”

alakh mukhopadhyay gold coin kalighat
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy