Advertisement
E-Paper

নারকেল ফুলের নীরা দেখাচ্ছে বিকল্প দিশা

ফুলের মিষ্টি রস। সরকারি নাম ‘নীরা’। তবে যে গাছ থেকে মিলছে তা ফুল নয়, ফলের জন্যই প্রসিদ্ধ। উত্তর-পূর্ব ভারতে এই প্রথম এ রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে নারকেল গাছের ফুল (মুচি) থেকে রস বার করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্প তত্ত্বাবধায়কদের দাবি, ডায়াবেটিজে আক্রান্তেরাও নির্দ্বিধায় পান করতে পারেন এ রস। খেতে পারেন ‘নীরা’ থেকে বানানো চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টি। সারা বছর মেলা এই রসের দৌলতে রাজ্যে বিকল্প চাষের নতুন দরজা খুলতে পারে বলে আশাবাদী তাঁরা।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০২:১৪
নারকেলের ফুল থেকে রস নিংড়ানো হচ্ছে। ছবি: সুশান্ত সরকার।

নারকেলের ফুল থেকে রস নিংড়ানো হচ্ছে। ছবি: সুশান্ত সরকার।

ফুলের মিষ্টি রস। সরকারি নাম ‘নীরা’। তবে যে গাছ থেকে মিলছে তা ফুল নয়, ফলের জন্যই প্রসিদ্ধ। উত্তর-পূর্ব ভারতে এই প্রথম এ রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে নারকেল গাছের ফুল (মুচি) থেকে রস বার করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্প তত্ত্বাবধায়কদের দাবি, ডায়াবেটিজে আক্রান্তেরাও নির্দ্বিধায় পান করতে পারেন এ রস। খেতে পারেন ‘নীরা’ থেকে বানানো চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টি। সারা বছর মেলা এই রসের দৌলতে রাজ্যে বিকল্প চাষের নতুন দরজা খুলতে পারে বলে আশাবাদী তাঁরা।

বিশ্বে অন্যতম প্রধান নারকেল উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় নাম রয়েছে ভারতের। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে ১৮.৯৫ লক্ষ হেক্টরেরও বেশি জমিতে নারকেলের চাষ হয়। কেরল, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, গোয়া, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গ এবং লাক্ষাদ্বীপে এই চাষ বেশি। কিন্তু গাছের নানা রোগ, পোকার আক্রমণ এবং বাজারে প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ার মতো বিভিন্ন কারণে চাষিরা দিনদিন নারকেল-চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন।

এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’ (আইসিএআর)-এর অন্তর্গত কেরলের ‘সেন্ট্রাল প্ল্যান্টেশন ক্রপস্ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (সিপিসিআরআই)-এর বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই নারকেলের উপর গবেষণা চালিয়ে আসছেন। তাঁদের লক্ষ্য, নানা উপায়ে নারকেল গাছকে কাজে লাগানো। সিপিসিআরআইয়ের ডিরেক্টর পি চৌডাপ্পা এবং দুই বিজ্ঞানী কে বি হেব্বার এবং এইচ পি মহেশ্বরাপ্পার তত্ত্বাবধানে হুগলির বলাগড়ে এক কৃষিজীবী পরিবারের বাগানে নারকেলের ফুল থেকে রস বার করার কাজ (পাইলট প্রজেক্ট) শুরু হয়েছে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপককুমার ঘোষ (হুগলির প্রাক্তন জেলা উদ্যান আধিকারিক) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকও রয়েছেন প্রকল্পে।

বাগানটিতে প্রায় তিনশো নারকেল গাছ রয়েছে। ফুল থেকে রস সংগ্রহ করার পরে ছেঁকে ঠান্ডা জায়গায় রাখা হচ্ছে, যাতে গেঁজে না যায়। হালকা ক্রিম রঙের মিষ্টি ‘নীরা’য় নানা ধরনের খনিজ পদার্থ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন রয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিজ্ঞানী অসিত চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘এই রস পান করলে ডায়াবেটিজে আক্রান্তদের চিন্তার কারণ নেই। কারণ, এতে রক্তে মেশে এমন শর্করার পরিমাণ অত্যন্ত কম।’’ একমত এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ঐশ্বর্যদীপ ঘোষ।

নারকেল গাছ থেকে বছরে ১০০-১২০টি নারকেল পাওয়া যায়। যার বাজারদর বাবদ চাষি পান এক হাজার থেকে বারোশো টাকার মধ্যে। কেন্দ্র সরকারের ‘কোকোনাট ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’ (সিডিবি)-এর ডেপুটি ডিরেক্টর খোকন দেবনাথ বলেন, ‘‘একটি নারকেল গাছে প্রতি মাসে একটি করে ফুল (মুচি) হয়। সারা বছরে যে ফুল থেকে গড়ে অন্তত ২০০-২৫০ লিটার মিষ্টি রস বার করা সম্ভব। কর্ণাটক-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নীরা তৈরির অনুমতি ইতিমধ্যেই দিয়েছে।’’ সরকারি ভাবে প্রতি লিটার রসের দাম অন্তত ৬০ টাকা ধরা হয়েছে। সিডিবি-র হিসেবে একটি গাছ থেকেই বছরে ১২-১৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

কৃষি এবং উদ্যানপালন দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যে মোট যা নারকেল গাছ রয়েছে তার ৭৫ শতাংশ ডাবের জন্য ব্যবহার করা হয়। ২০ শতাংশ থেকে নারকেল নেওয়া হয়। বাকি পাঁচ শতাংশে ফল হয় না। প্রকল্পে যুক্ত বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপকবাবু জানাচ্ছেন, হিসেব করে দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের এক শতাংশ গাছ থেকে বছরে ১,০২৪ লক্ষ লিটার রস পাওয়া সম্ভব। যার বাজারদর প্রায় ৬২ লক্ষ টাকা। এক জন চাষি এক হেক্টর (সাড়ে সাত বিঘে) জমিতে নারকেল গাছ লাগালে, সে সব গাছের ফুল থেকে সারা বছরে প্রায় ২১ লক্ষ টাকার রস বিক্রি করতে পারবেন। বিশ্বের বাজারে নারকেলের ফুলের এই রসের তৈরি চিনির বাজারও প্রতিদিন বাড়ছে। দীপকবাবুর আশা, ‘‘বিকল্প চাষে অর্থকরী ফসল হিসেবে নীরা আগামী দিনে বড় ভূমিকা নিতে পারে।’’

যাঁদের বাগানে চলছে এই প্রকল্প সেই দেবাশিস এবং কৌশিক ঘোষের বক্তব্য, ‘‘নারকেলের ফুলের রসের বাজার রয়েছে। সে জন্যই এমন বিকল্প চাষে উৎসাহী হয়েছি।’’ কেরলে ‘নীরা’ থেকে চিনি তৈরির খবর রয়েছে বিশিষ্ট মিষ্টিপ্রস্তুতকারক অমিতাভ দে-র কাছেও। রিষড়ার ‘ফেলু মোদক’-এর অন্যতম কর্ণধার অমিতাভবাবু জানান, তাঁরা ‘নীরা’কে ‘হেল্থ ড্রিঙ্ক’ হিসেবে বাজারে আনতে চান। আবার ওই রস থেকে তৈরি চিনি দিয়ে ডায়াবেটিজ আক্রান্তদের জন্য মিষ্টি বানানোর পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁদের।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy