Advertisement
E-Paper

প্রেসিডেন্সির ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফোনে মেয়ে বলেছিল, সকাল সাড়ে সাতটায় ডেকে দিতে। সেই মতো রবিবার সকালে জলপাইগুড়ি থেকে ফোন করেছিলেন বাবা। কিন্তু বারবার ফোন বেজে গেল, মেয়ের সাড়া মিলল না। ঘণ্টা দুয়েক পর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (২২) যখন দরজা ভেঙে উদ্ধার করল পুলিশ, তখন তাঁর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৩
সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুবর্ণা লামা

সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুবর্ণা লামা

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফোনে মেয়ে বলেছিল, সকাল সাড়ে সাতটায় ডেকে দিতে। সেই মতো রবিবার সকালে জলপাইগুড়ি থেকে ফোন করেছিলেন বাবা। কিন্তু বারবার ফোন বেজে গেল, মেয়ের সাড়া মিলল না।

ঘণ্টা দুয়েক পর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (২২) যখন দরজা ভেঙে উদ্ধার করল পুলিশ, তখন তাঁর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সুমন্তিকাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। সুমন্তিকার সঙ্গেই অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল তাঁর রুমমেট সুবর্ণা লামাকে। কার্শিয়াঙের মেয়েটি এখন চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উল্টো দিকে আরপুলি লেনে এই রহস্যজনক ঘটনায় রবিবার চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ঠিক কী কারণে এমন ঘটল, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এখনও। এ দিন সন্ধ্যায় সুবর্ণাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। কিন্তু তাতেও মৃত্যুর কারণ নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট সূত্র মেলেনি বলেই তদন্তকারীদের দাবি। দু’টি মেয়ে একসঙ্গে কী ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, শান্ত স্বভাবের ছাত্রী হিসেবে পরিচিত সুমন্তিকা স্নাতক স্তর থেকেই প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন। বিএসসি-তে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে এখন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এমএসসি প্রথম বর্ষে পড়ছিলেন। আরপুলি লেনে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতেন। গত চার বছরে কখনও কোনও গোলমালে তাঁকে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। এ দিন আচমকা এই ঘটনার পরে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের তরফে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনার বলেন, “এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় উপাচার্য এবং অন্য শিক্ষকেরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।”

সুমন্তিকার পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বড়দিনের ছুটিতে সুমন্তিকা জলপাইগুড়ির বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে ছুটি কাটিয়ে শনিবার সকালেই তিনি কলকাতায় পৌঁছন। সুমন্তিকার বাবা দেবাশিসবাবু জানান, শনিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তাঁর সঙ্গে মেয়ের কথা হয়েছিল। তখন সুমন্তিকা রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। সুমন্তিকা বাবাকে জানান, রবিবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ফোন করে ঘুম থেকে তুলে দিতে। সেই মতো সকালে ফোন করেন দেবাশিসবাবু। কিন্তু সুমন্তিকার ফোন বেজেই যাচ্ছিল। ঘাবড়ে গিয়ে দেবাশিসবাবু সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ সুমন্তিকার বাড়ির মালকিন রমা চৌধুরীকে ফোন করে বিষয়টি জানান।

রমাদেবী এ দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাঁর বাড়ির একতলায় চারটি ঘরে মোট বারো জন তরুণী ‘পেয়িং গেস্ট’ হিসাবে থাকেন। তারই একটি ঘরে মাস ছয়েক ধরে ছিলেন সুমন্তিকা। মাস তিনেক আগে সুবর্ণাও সেখানে আসেন। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রমাদেবী জানান, এ দিন সকালে দেবাশিসবাবুর ফোন পেয়ে তিনি একতলায় এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন। তাতেও দরজা না খোলায় তিনি খবর পাঠান সুবর্ণার স্থানীয় অভিভাবক তাপস দত্ত নামে এক ব্যক্তিকে। অন্য ঘরের বাসিন্দা এবং পড়শিদের নিয়ে তাপসবাবুই দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন। রমাদেবী বলেন, “ভিতরে একটি খাটের উপরে সুমন্তিকা উপুড় হয়ে পড়েছিলেন। অন্য একটি খাটে অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিলেন সুবর্ণা।” রমাদেবীরাই দু’জনকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সুমন্তিকার বাড়িতেও খবর দেওয়া হয়। বিমানে কলকাতায় চলে আসেন সুমন্তিকার কাকা ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

রমাদেবী পুলিশকে বলেছেন, সুমন্তিকা কলকাতায় আসার পর থেকেই অসুস্থ ছিলেন। শনিবার দু’বার অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কয়েক বার বমিও করেছিলেন। রাতে সূর্য সেন স্ট্রিটের এক চিকিৎসক বাড়িতে এসে তাঁকে দেখে যান। সে সময় তাঁর রক্তচাপ সামান্য কম ছিল। চিকিৎসক কিছু ওষুধ দিয়েছিলেন। অন্য আবাসিকরা ওষুধ এনে দেন। তবে দেবাশিসবাবু বলছেন, “শনিবার রাতে মেয়ে আমায় আলাদা করে শরীর খারাপের ব্যাপারে কিছু জানায়নি। যদিও শুক্রবার জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার সময়ে জ্বর, সর্দি ছিল। ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। তখন সুমন্তিকার রক্তচাপ ১১০/৭০।” পুলিশের একটি সূত্রের খবর, সুমন্তিকার চোখেও সমস্যা ছিল। সেই সঙ্গে আরও কিছু সমস্যার কারণে নিয়মিত ওষুধ খেতে হতো তাঁকে।

হাসপাতালে ভর্তি সুবর্ণার সঙ্গে এ দিন অল্পই কথাবার্তা বলতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। সুবর্ণা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, শনিবার রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ওঁরা দু’জনে গল্প করেছিলেন। তার আগে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ অন্য দিনের মতো রমাদেবীর কাছ থেকে আসা খাবার খেয়েছিলেন। রুটি, কুমড়োর তরকারি ও ডিমের ওমলেট। সুমন্তিকা ওমলেট খেলেও তিনি খাননি বলে তদন্তকারীদের জানিয়েছেন সুবর্ণা। তাঁর কথায়, শনিবার বিকেলে তিনি বাইরে চাউমিন খেয়েছিলেন। তার পর থেকেই তাঁর শরীর খারাপ ছিল। ওই কারণেই ওমলেট খাননি। তবে পুলিশের কাছে সুবর্ণার দাবি, গভীর রাতে এবং রবিবার সকালে তাঁর দু’বার ঘুম ভেঙেছিল। সেই সময় তিনি সুমন্তিকাকে স্বাভাবিক অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখেছেন। এ দিন সকালে প্রতিদিনের মতো ঘরে চা দিয়ে যায়নি কেউ। সুর্বণার দাবি, পরে তাঁর ঘুম ভাঙলে তিনি নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পান।

বিকেলে পুলিশ মর্গে সুমন্তিকার ময়নাতদন্ত হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ জানাননি। প্রাথমিক ভাবে কোনও বিষক্রিয়ার কথাও বলা হয়নি। সুমন্তিকার যকৃৎ, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাকস্থলীতে অর্ধপাচ্য খাবার মিলেছে। তবে তাঁর শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। তার ভিত্তিতে পুলিশের অনুমান, মাঝরাতের পর মৃত্যু হয় সুমন্তিকার। পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “ওই ছাত্রীর দেহাংশ ও রক্তের নমুনা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।”

গত বছর এসএসকেএম হাসপাতালের এক ছাত্র-চিকিৎসকের দেহ এ ভাবে উদ্ধার হয়েছিল। ময়নাতদন্তের পর জানা গিয়েছিল, অতিরিক্ত মাদক সেবনই মৃত্যুর কারণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রবিবার রাত পর্যন্ত তেমন কোনও সূত্র মেলেনি বলেই পুলিশের দাবি। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “মাদক সেবন করলে ঘরের ভিতর থেকে তার প্রমাণ মিলত। এ ক্ষেত্রে তেমন কিছু মেলেনি। ময়নাতদন্তেও প্রাথমিক ভাবে তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই।”

তা হলে কী করে মারা গেলেন সুমন্তিকা? সুমন্তিকাদের ঘর তল্লাশি করে তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, ১৪ বাই ১২ ফুটের এই ঘরটিতে কোনও ‘ভেন্টিলেশন’ নেই। ঘরে চার জন পেয়িং গেস্ট থাকতেন। শনিবার অবশ্য ঘরটিতে সুমন্তিকা এবং সুবর্ণা দু’জনেই ছিলেন। অন্য দু’জন এখনও ফেরেননি। ঘটনার পরে ঘরের ভিতরে ঝাঁঝালো গন্ধ মিলেছে বলে পুলিশের দাবি। তবে সেই গন্ধের কোনও উৎস তারা খুঁজে পায়নি। অথচ সকালে যখন অচেতন ছাত্রীদের দেখেন অন্য আবাসিকরা, তখন সুমন্তিকার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল। খাবারে বিষক্রিয়া হলে এমনটা হতে পারে। কিন্তু পুলিশের প্রশ্ন, “সুমন্তিকা-সুবর্ণা যে খাবার খেয়েছিলেন, অন্য আবাসিকরাও তাই খেয়েছেন। খাবারে বিষক্রিয়া হলে শুধু ওই দু’জনই অসুস্থ হলেন কেন?” ঠিক কী ঘটেছিল তা জানার জন্য বাড়ির মালিক রমাদেবী এবং চিকিৎসাধীন সুবর্ণা এবং অন্য আবাসিকদের আরও জেরা করা হবে। লালবাজার সূত্রের খবর, ফরেন্সিক বিভাগকে খবর দেওয়া হয়েছে। তাঁদের নিয়ে আজ, সোমবার ফের তল্লাশি চালাতে পারেন গোয়েন্দারা।

sumontika bandyopadhyay subarna lama arpuli lane
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy