Advertisement
০৫ মে ২০২৪

প্রশাসনের দুশ্চিন্তার সেই শ্যাডো জোনে ছায়া সন্ত্রাসের

চার রাস্তার সংযোগস্থল। তবে ফুটিসাঁকো কার্যত তিন জেলার মোড়! বাদশাহি সড়কের উপরে ফুটিসাঁকো মোড়, জেলা বর্ধমান। যেখান থেকে বীরভূম সীমানা বলতে গেলে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। পশ্চিমের রাস্তা ধরে আট কিলোমিটার গেলে বীরভূমের কীর্ণাহার। সেখানে পথ দু’ভাগ একটির গন্তব্য নানুর হয়ে বোলপুর, অন্যটির সিউড়ি। ফুটিসাঁকো মোড় থেকে পূর্বমুখী রাস্তা গিয়েছে বর্ধমানের কেতুগ্রাম হয়ে কাটোয়া পেরিয়ে নবদ্বীপের দিকে।

দেবব্রত ঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৫২
Share: Save:

চার রাস্তার সংযোগস্থল। তবে ফুটিসাঁকো কার্যত তিন জেলার মোড়!

বাদশাহি সড়কের উপরে ফুটিসাঁকো মোড়, জেলা বর্ধমান। যেখান থেকে বীরভূম সীমানা বলতে গেলে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। পশ্চিমের রাস্তা ধরে আট কিলোমিটার গেলে বীরভূমের কীর্ণাহার। সেখানে পথ দু’ভাগ একটির গন্তব্য নানুর হয়ে বোলপুর, অন্যটির সিউড়ি। ফুটিসাঁকো মোড় থেকে পূর্বমুখী রাস্তা গিয়েছে বর্ধমানের কেতুগ্রাম হয়ে কাটোয়া পেরিয়ে নবদ্বীপের দিকে। দক্ষিণমুখী পথ অজয়ের উপরে নতুনহাটের সেতু পার হয়ে রওনা দিয়েছে মঙ্গলকোট হয়ে বর্ধমান। উত্তরমুখী রাস্তা পাঁচ-ছ’কিলোমিটার গিয়েই ঢুকে পড়েছে মুর্শিদাবাদের চৌহদ্দিতে। পাঁচথুপি, কান্দি হয়ে সোজা বহরমপুর।

এ হেন ফুটিসাঁকোকে কেন্দ্রে রেখে ভদ্রলোক স্কেল দিয়ে অদৃশ্য বৃত্ত আঁকলেন। দেওয়ালে ঝোলানো পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের গায়ে।

না, ভূগোলের ক্লাস নয়। বীরভূম, বধর্মান, মুর্শিদাবাদ প্রশাসনে একদা বিবিধ প্রশাসনিক গুরুদায়িত্ব সামলে আসা অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার বোঝাচ্ছিলেন অঞ্চলটির গুরুত্বের কথা। বীরভূমের জেলাশাসক বা বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক হিসেবে কাজ করার সুবাদে গোটা তল্লাটটি তাঁর কাছে নিজের হাতের তেলোর মতো চেনা। বললেন, “এই যে বৃত্তটা, এর ব্যাসার্ধ খুব বেশি হলে পনেরো-কুড়ি কিলোমিটার। অথচ বৃত্তের মধ্যে তিনটে জেলাই ঢুকে গিয়েছে! প্রশাসনেরও তাই মাথাব্যথার অন্ত নেই।” কেন?

প্রশাসনের কর্তাদের ব্যাখ্যা: রাজনৈতিক সংঘর্ষ হোক, কিংবা খুন-ডাকাতি-ধর্ষণ-রাহাজানি, যে কোনও অপরাধ ঘটানোর পরে অপরাধীরা হামেশা এমন অঞ্চলকে ‘স্ট্র্যাটেজিক জোন’ হিসেবে ব্যবহার করে। পুলিশের নাগাল এড়াতে অল্প সময়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে গা ঢাকা দিতে পারে। ঘুম ছোটে অফিসারদের। “আমরা প্রশাসনিক স্তরে এই ধরনের অঞ্চলকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ শ্যাডো জোন হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি।” জানাচ্ছেন প্রাক্তন আমলাটি।

এ বার অবশ্য রাজনৈতিক সংঘর্ষ বা চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির ব্যাপার নয়। সাম্প্রতিক খাগড়াগড় বিস্ফোরণের প্রেক্ষাপটে ‘শ্যাডো জোনে’ সরাসরি পড়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কালো ছায়া। সন্ত্রাস-চক্রান্তের একই সূত্র খাস বর্ধমান শহরের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া, বীরভূমের নিমড়ে ও মুর্শিদাবাদের বেলডাঙাকে। সড়ক যাতায়াত সহজ হওয়ায় চক্রীদের কাছে কাজটা আরও অনায়াস হয়েছে বলে অনেকের অভিমত। কীর্ণাহারের এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, “রাস্তাঘাটের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এখন তো আমরা প্রায়ই মুর্শিদাবাদ সীমানার গ্রামে পেশেন্ট দেখতে যাই! কখনও গাড়িতে, কখনও মোটরবাইকে।”

বস্তুত গ্রামবাংলার অধুনা ‘বাইক-বিপ্লব’ও প্রশাসনের ছায়া-অঞ্চলে বাড়তি মাত্রা জুড়েছে। প্রাক্তন ওই জেলাশাসক বলছেন, “আগে চুরি-ডাকাতি করে পালানোর সময় এখানকার অপরাধীরা কখনও গাড়ি ব্যবহার করত না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যেত, তারা মাঠ ভেঙে, আল ভেঙে পাশের জেলায় গা ঢাকা দিয়েছে। কখনও বা সাইকেলে চড়ে পালিয়েছে।” কিন্তু খাগড়াগড়-কাণ্ডে বিস্তর মোটরবাইকের যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি: খাগড়াগড়ের বাড়িতে যারা আনাগোনা করত, সকলেই আসত মোটরসাইকেলে চড়ে।

অর্থাৎ, মসৃণ সড়কযাত্রা ও মোটরবাইকের ব্যবহার সন্ত্রাসবাদীদের কাজকে আরও সহজ করে দিয়েছে। বিস্ফোরণের পরে পরেই বেশ কিছু নারী-পুরুষ পাততাড়ি গুটিয়েছে। তদন্তকারীরা বলছেন, উন্নত পথ-যোগাযোগের দৌলতে শিমুলিয়া বা বাবুরবাগ থেকে রওনা দিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মুর্শিদাবাদে ঢুকে পড়া সম্ভব। আবার কাটোয়া হয়ে নদিয়ায় পৌঁছতে মোটরবাইক বা গাড়িতে আড়াই-তিন ঘণ্টাই যথেষ্ট। আর তার পরে সীমান্ত ডিঙিয়ে ও-পারে গা ঢাকা দেওয়াটা পোড় খাওয়া দুষ্কৃতীদের পক্ষে কঠিন নয়।

ফলে বর্ধমান-তদন্তের বৃত্তেও ক্রমশ কেন্দ্রে আসছে শ্যাডো জোন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debabrata thakur nia khagragarh blast case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE