সিবিআই তাঁকে আর নিজেদের হেফাজতে রাখতে চায়নি। তদন্তকারীদের জেরা থেকে মুক্তি চাইছিলেন তিনি নিজেও। সাত দিন ধরে সিবিআই জেরার পরে দৃশ্যতই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত মদন মিত্রকে শুক্রবার আদালতের নির্দেশে নিয়ে যাওয়া হল আলিপুর জেলে। আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে মন্ত্রিত্বে থাকাকালীনই রাজ্যে এই প্রথম কোনও নেতা জেলে গেলেন। পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রীকে আপাতত ১৪ দিনের জন্য জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আলিপুর আদালত।
রাতেই অবশ্য বুকে ব্যথা অনুভব করায় এবং চোখে অন্ধকার দেখায় মদনবাবুকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে রাখা হয়েছে। ঘটনাচক্রে তাঁর পাশের কেবিনটিতেই আছেন সারদা কাণ্ডে ধৃত তৃণমূলের আর এক সাংসদ সৃঞ্জয় বসু। আজ, শনিবার মদনবাবুর চিকিৎসায় মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হবে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে।
এ দিন আদালতে মদনবাবু জামিনের আবেদন করলে তার বিরোধিতা করে সিবিআই। আদালতে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটির আইনজীবী পার্থসারথি দত্ত জানান, সিবিআই আর মদনবাবুকে নিজেদের হেফাজতে চায় না। আপাতত তাঁর কাছ থেকে যা জানার, তা জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী জামিন পেয়ে যান, তা-ও চায় না তারা। কেন? পার্থসারথিবাবু আদালতে বলেন, “উনি যে কত ক্ষমতাশালী, তা তো তিন দিন আদালতে নিয়ে আসার সময়েই দেখা গিয়েছে! এমন এক প্রতাপশালী অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে গেলে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাইরে থাকলে এই মামলার সাক্ষীদেরও তিনি প্রভাবিত করতে পারেন।”
সিবিআইয়ের অভিযোগ, মদন মিত্র সারদার একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সাধারণ মানুষকে অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ওঁকে জেরা করে বহু নতুন তথ্য উঠে এসেছে। সেগুলি যাচাই করা হচ্ছে। আরও কিছু তথ্যপ্রমাণ তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই পরে আবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলেও সিবিআই আদালতে জানিয়েছে।
আগের দিন আদালতে দাঁড়িয়ে মদনবাবু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করেছিলেন, যে সিবিআই অফিসারেরা জোর করে তাঁকে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নাম বলাতে চাইছেন। এমন কথাও বলাতে চাইছেন যে, মুখ্যমন্ত্রীও সারদার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। এ দিন শুনানির শুরুতেই ফের সেই প্রসঙ্গটি তুলে মন্ত্রীর আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায় আবেদন করেন, আদালতের নির্দেশের মধ্যে বিষয়টি লেখা হোক। বিচারককে তিনি বলেন, “গত দিন আমার মক্কেল এই প্রসঙ্গটা তুললেও তা নির্দেশে লেখেননি। ওই প্রসঙ্গটা এ দিন নির্দেশে উল্লেখ করে দিলে পরবর্তী সময়ে আমার মক্কেল চাইলে উচ্চতর আদালতে বিষয়টি উত্থাপন করতে পারবেন।” আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে মমতার নাম জড়িয়ে রাখতে মদনবাবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ওই কথা বলেছিলেন। এর আগে একই কৌশলে মমতার নাম আদালতে তুলে দিয়েছিলেন তৃণমূলের সহ-সভাপতি রজত মজুমদার।
গত দু’দিনের মতো এ দিনও শুনানির সময়ে আদালত কক্ষের ভিতরে যথেষ্ট ভিড় ছিল। শুনানি শুরু হয় দুপুর ২টো ২০ নাগাদ। মদন মিত্রকে আনা হয় ২টোর কিছু আগেই। সঙ্গে ছিলেন সারদা মামলায় আর এক অভিযুক্ত, সুদীপ্ত সেনের আইনজীবী নরেশ ভালোড়িয়া। কাঠগড়ার ধারে পাশাপাশি দু’টি চেয়ার এনে বসানো হয় দু’জনকে। মন্ত্রী ঢোকার আগে আদালত কক্ষ একেবারেই ফাঁকা ছিল। কিন্তু তিনি আসার পরেই বহু লোক এজলাসে ঢুকে পড়ে। এঁদের বেশির ভাগই মদনবাবুর অনুগামী আইনজীবী।
এ দিনও আদালত চত্বরে হাতে ফুল নিয়ে ভিড় করেছিলেন মন্ত্রীর অনুগামীরা। শঙ্খ ও উলুধ্বনির মাঝে ‘বাংলার দামাল ছেলে মদন মিত্র জিন্দাবাদ’ স্লোগানও দেওয়া হয়। ঘিয়ে রঙের হাফ হাতা পাঞ্জাবি, সাদা চোস্ত এবং স্নিকার্স পরেছিলেন মন্ত্রী। এ দিনও তিনি নিজে সওয়াল করেছেন। করজোড়ে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “স্যার, আমি সিবিআইয়ের অফিসে তখন একা বসেছিলাম। এক অফিসার এসে বললেন, ভয়েস রেকর্ড করা হবে। আমি বললাম, দেবো না। আমাকে আমার আদালত (আগের দিন এই আদালতে করা আর্জির প্রেক্ষিতে তাঁর দাবি) বারণ করেছে। সিবিআই অফিসার তখন বলেন, ওই সব আদালত-টাদালত জানি না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে। আমি বলেছি সুপ্রিম কোর্ট বুঝি না। আমাকে এই আদালত বারণ করেছে। তখন আমাকে বললেন, আপনি রেকর্ডিং না করলে সুপ্রিম কোর্ট আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে। স্যার, এ ভাবে আমার উপরে চাপ তৈরি করা হচ্ছে।”
মন্ত্রীর অভিযোগ, তাঁকে সিবিআই বলেছে, বিষ্ণুপুরে তিনি সারদার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার পরে ২৬ লক্ষ মানুষ প্রভাবিতহয়ে সারদায় টাকা ঢেলেছেন। আদালতে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী বলেন, “১৭ নভেম্বর এই মামলায় সিবিআই চার্জশিট জমা দিয়েছে। কই সেখানে তো কোথাও তারা বলতে পারেনি যে একটা মানুষও আমার নাম করে বলেছে, মদন মিত্র বলেছে বলে আমি সারদায় টাকা রেখেছি!
তা হলে কী জন্য আমাকে গ্রেফতার করা হল?”
দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায় মদনবাবুকে জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর আইনজীবীর দাবি মেনে তিনি জানিয়ে দেন, রাজ্যের জেল বিধি অনুযায়ী মদনবাবুকে প্রথম শ্রেণির বন্দির মর্যাদা দেওয়া হবে। জেলে থাকা অন্য কোনও এক জন বন্দিকে তিনি সহকারী হিসেবেও পাবেন। যা শুনে খানিকটা স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন মন্ত্রী। তাঁর ঘনিষ্ঠমহল জানাচ্ছে, জেলের ভিতরটা যে হেতু রাজ্য সরকারের অধীনে, তাই এখানে নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে পারবেন মদনবাবু। প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে ঘরে খাট-বিছানা ছাড়াও খবরের কাগজ, টিভিও পাবেন তিনি। মিলবে সাধারণ বন্দিদের চেয়ে ভাল খাবারও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy