একেই জমি-নীতির ফাঁস। তার উপরে সরকারি কাজকর্মের চিরাচরিত ঢিলেমি। দুইয়ে মিলে পশ্চিমবঙ্গের মালদহের সঙ্গে বিহারের কাটিহারকে জাতীয় সড়কপথে যুক্ত করার উদ্যোগ কার্যত চলে গিয়েছে বিশ বাঁও জলে। কেন্দ্রের টাকা এসেও পড়ে রয়েছে।
এবং ব্যর্থতার দায়ভার বর্তাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গেরই ঘাড়ে। কেননা নতুন সড়ক তৈরির জন্য পড়শি দুই রাজ্যের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিয়েছিল কেন্দ্র। এ বাবদ দিল্লি বেশ কিছু টাকা অগ্রিমও দিয়েছিল। দু’রাজ্যের সরকারি তথ্য বলছে, বিহারের দিকে কাজ প্রায় শেষ। অথচ পশ্চিমবঙ্গ বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্টই (ডিপিআর) খাড়া করে উঠতে পারেনি! যার কারণ হিসেবে আবার সামনে উঠে আসছে জমি অধিগ্রহণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অনীহার বিষয়টি।
মালদহের গাজল ছুঁয়ে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। অন্য দিকে বিহারের কোরা স্পর্শ করেছে ৩১ নম্বর। দু’টিকে জুড়তে ৮১ নম্বর জাতীয় সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা কেন্দ্র ঘোষণা করেছিল ২০০০ সালে। স্থির হয়, গাজল থেকে সামসি-চাঁচল-মালতিপুর-হরিশ্চন্দ্রপুর-পিপলা-কাশিমপুর হয়ে বিহার সীমানার সহারা-বহরা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক বানাবে পশ্চিমবঙ্গ। আর মহানন্দার উপরে সেতু গড়ে কাটিহার হয়ে কোরা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটারের দায়িত্ব বিহারের। সব মিলিয়ে ৯২ কিলোমিটার। যার সুবাদে মালদহ-কাটিহার সড়কযোগ হবে মসৃণ।
পটনা-সূত্রের খবর: প্রকল্প ঘোষণার পরে বিহারের তদানীন্তন নীতীশকুমার সরকার তড়িঘড়ি সমীক্ষা-রিপোর্ট তৈরি করে কাজে নামে। ২০০৯-এ লাভা স্টেশনের কাছে মহানন্দায় নবনির্মিত সেতুটির উদ্বোধনও করে দেন নীতীশ। এখন বাকি ৩০ কিলোমিটারের কাজ চলছে। কাটিহার জেলা প্রশাসন জানাচ্ছে, ওই ৩০ কিলোমিটার ‘বিহার রাজ্য সড়ক’ হিসেবে পরিচিত। সেটিকেই আরও মজবুত ও চওড়া করে জাতীয় সড়কে উন্নীত করা হবে। কাটিহারের সাংসদ তারিখ আনোয়ারের কথায়, “নব্বই শতাংশ কাজ সারা। বাকিটা হচ্ছে। আশা করি, এ বছরে শেষ হয়ে যাবে।”
বিহার যা প্রায় সেরে ফেলল, পশ্চিমবঙ্গ তা আরম্ভই করতে পারল না কেন?
সরকারি মহলের বক্তব্যে স্পষ্ট, জমির বাধা অন্যতম কারণ। রাজ্য পূর্ত দফতরের খবর: পশ্চিমবঙ্গের ৬২ কিলোমিটারের মধ্যে ৪৯ কিলোমিটার রাজ্য সড়ক। জাতীয় সড়কের নিয়মানুযায়ী এই অংশটি দশ মিটার চওড়া ও তেমন মজবুত করতে হবে। বাকি ১৩ কিলোমিটার কার্যত চাষের খেত। সেখানে রাস্তা বানাতে ৩৪০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। “কিন্তু পুরনো অংশ সংস্কার বা জমি অধিগ্রহণ, কোনওটাই শুরু করা যায়নি।” বলছেন এক পূর্তকর্তা। তাঁদের দাবি, রাজ্য সরকারের জমি-নীতির জেরেই অধিগ্রহণের পথে এগোনো যাচ্ছে না।
ফলে পুরো প্রকল্প আটকে যাচ্ছে। ঘটনা হল, সংশ্লিষ্ট জমি-মালিকদের অধিকাংশই কিন্তু উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে জমি দিতে প্রস্তুত। ওঁদের একটা বড় অংশ বিহারের বাসিন্দা। যেমন শিববচন যাদব। যিনি বলছেন, “রাস্তার জন্য আমার সাত বিঘে জমি মাপা হয়েছে। সবটাই ধানি, দু’বার ফসল হয়। ভাল দাম পেলে দিয়ে দেব।” ওঁর মতো শিবরতন যাদব, দিলীপ মণ্ডল, গঙ্গাপ্রসাদেরাও পছন্দসই দাম পেলে জমি দিতে রাজি। অথচ পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের তরফে তেমন চাড় দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ।
অধিগ্রহণের সমস্যা না হয় আছে। কিন্তু এখনকার ৪৯ কিলোমিটার রাস্তাকে জাতীয় সড়কে উন্নীতকরণের কাজেও কেন হাত পড়ল না? ওখানেও কি জমির বাধা?
তা অবশ্য নয়। বরং এ ক্ষেত্রে সরকারের গয়ংগচ্ছ মনোভাবের দিকেই আঙুল তুলছেন পূর্তকর্তাদের একাংশ। জানাচ্ছেন, রাজ্য সড়ক সম্প্রসারণের মতো যথেষ্ট জমি দু’ধারে রয়েছে। অধিকাংশ ফাঁকা, কিছু জায়গায় দখলদার বসেছে। ফোন-বিদ্যুতের খুঁটি, জলের লাইন, গাছ ইত্যাদিও রয়েছে। সে সব সরানো হয়নি। অথচ প্রকল্পের প্রাথমিক খরচ বাবদ গত বছরে দিল্লি ৯০ কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছে। আপাতত যা নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে আছে রাজ্যের কোষাগারে।
এমতাবস্থায় স্থানীয় বাসিন্দারা বিলক্ষণ হতাশ। বস্তুতই রতুয়া, ভালুকা, হরিশ্চন্দ্রপুর, সামসি বা চাঁচলের লোকজনকে নানা কাজে হামেশা কাটিহার-পূর্ণিয়ায় ছুটতে হয়। এখন একমাত্র ভরসা ট্রেন সকাল, বিকেল মিলিয়ে দিনে সাকুল্যে দু’টো। সড়কপথে বহু ঘুরতে হয়। “নতুন রাস্তায় সময় লাগত অর্ধেক।” বলছেন ওঁরা। এ-ও আক্ষেপ, আপাতত মহানন্দা সেতু থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরের দিকে ওই ১৩ কিলোমিটার অন্তত বানিয়ে ফেলা গেলেও কাটিহার-মালদহ যোগাযোগ কিছুটা সহজ হতো। রাজ্য পূর্ত দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার শঙ্কর চক্রবর্তীও বলছেন, “বিহার সীমানা থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরের পিপলা পর্যন্ত একটা মিসিং লিঙ্ক রয়েছে। সেটুকু হয়ে গেলেই বিহারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সম্ভব।”
সেটুকুও করে ওঠা যাচ্ছে না কেন? চিফ ইঞ্জিনিয়ারের জবাব, “কারণ বলা মুশকিল। তবে এখন ডিপিআরের কাজ চলছে জোরকদমে।” যদিও তা সেরে জমির সংস্থান করে আসল নির্মাণে কবে হাত পড়বে, তার আন্দাজই নেই সরকারি মহলে। পূর্তমন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মন্ত্রী ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব মেলেনি।
পুরো ঘটনাপ্রবাহে মালদহের কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূর যারপরনাই বিরক্ত। “বিহার রাস্তা-সেতু বানিয়ে ফেলল! আমরা জমি অধিগ্রহণই শুরু করতে পারলাম না! লজ্জা রাখব কোথায়!” মন্তব্য তাঁর। কাটিহারের সাংসদের প্রতিক্রিয়া, “পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ভূতল পরিবহণমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা বলব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy