Advertisement
E-Paper

ভাষণ নয় শিল্প চাই, মমতাকে শোনাল খড়্গপুর

সভা-বক্তৃতায় পেট ভরে না। অধিগৃহীত জমিতে শিল্প চাই, কাজ চাই। মুখ্যমন্ত্রী যে পথ ধরে আসবেন, তার ধারে দাঁড়িয়ে এই দাবি যাঁরা তুললেন, তাঁরা সরকারি প্রকল্পে জমি দিয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে সাদা কাগজে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে খড়্গপুরের বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকের জমিদাতাদের একাংশের বিক্ষোভ-কর্মসূচি ছিল মাত্র আধ ঘণ্টার। কিন্তু অনেকেই বলছেন, এই বিক্ষোভে যে প্রশ্ন তাঁরা তুলেছেন, তার গুরুত্ব মোটেই কম নয়।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৭
জমিদাতাদের একাংশের বিক্ষোভ। মঙ্গলবার খড়্গপুরের জফলায়। —নিজস্ব চিত্র।

জমিদাতাদের একাংশের বিক্ষোভ। মঙ্গলবার খড়্গপুরের জফলায়। —নিজস্ব চিত্র।

সভা-বক্তৃতায় পেট ভরে না। অধিগৃহীত জমিতে শিল্প চাই, কাজ চাই। মুখ্যমন্ত্রী যে পথ ধরে আসবেন, তার ধারে দাঁড়িয়ে এই দাবি যাঁরা তুললেন, তাঁরা সরকারি প্রকল্পে জমি দিয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে সাদা কাগজে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে খড়্গপুরের বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকের জমিদাতাদের একাংশের বিক্ষোভ-কর্মসূচি ছিল মাত্র আধ ঘণ্টার। কিন্তু অনেকেই বলছেন, এই বিক্ষোভে যে প্রশ্ন তাঁরা তুলেছেন, তার গুরুত্ব মোটেই কম নয়। কারণ, জমি রাজনীতির জোয়ার সম্বল করে ক্ষমতায় আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে এই বিক্ষোভ-বার্তা শুধু জমিদাতাদের নয় শিল্পমহল, বিরোধী, এমনকী, রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশেরও।

বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকে অধিগৃহীত জমির পরিমাণ ১,২৪৯ একর। তার মধ্যে ৯৪৪ একর সেই ২০০৬ থেকে পড়ে রয়েছে। জমির বিনিময়ে টাকা মিললেও, কারখানা না হওয়ায় চাকরি মেলেনি। এমন জায়গা তৃণমূলনেত্রীর সভার জন্য নির্বাচিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন জমিদাতারা। সোমবারই তাঁরা জানিয়েছিলেন, অধিগৃহীত জমিতে কর্মিসভা নয়, হোক শিল্প অগ্রাধিকার পাক কর্মসংস্থানের মতো জরুরি বিষয়। সেই ক্ষোভ মমতার সভার দিনে রূপান্তরিত হল বিক্ষোভে।

বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকের সভায় মমতা পৌঁছন দুপুর ১টা নাগাদ। কিন্তু সকাল ৮টাতেই সভাস্থলের বড়জোর পাঁচশো মিটার দূরে জমিদাতাদের বিক্ষোভে স্লোগান উঠেছিল, ‘আর ভাষণ নয়, এ বার শিল্প চাই, কাজ চাই’। বিক্ষোভে সামিল জমিদাতা চিত্ত রায়, শেখ ইনসান আলি, কালীপদ রায়রা বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এই কর্মসূচি। অনেক দিন গিয়েছে। আর নয়। আমরা চাই, শিল্পতালুকে এ বার শিল্প আসুক।”

এ দিনের বিক্ষোভ ‘স্বতঃস্ফূর্ত এবং অরাজনৈতিক’ বলেও দাবি জমিদাতাদের। তবে স্থানীয় সূত্রের খবর, বিক্ষোভের পিছনে বাম শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র বড় ভূমিকা ছিল। যদিও এআইটিইউসি-র পশ্চিম মেদিনীপুরের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব ভট্ট দাবি করেছেন, বিক্ষোভ-সংগঠনের দায়িত্ব তাঁরা নেননি। তবে তাঁদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তাঁর কথায়, “জমিদাতাদের বুকের উপরে মুখ্যমন্ত্রী সভা করলেন। অথচ, তাঁদের নিয়েই কোনও শব্দ খরচ করলেন না! জমিদাতারা তো হতাশ হবেনই।”

জমিদাতাদের এই বিক্ষোভকে আমল দিচ্ছেন না তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়। তিনি বলছেন, “এ সব সংবাদমাধ্যমের একাংশের তৈরি।” তবে রাজ্য তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা মেনে নিচ্ছেন, “শিল্পের জন্য জমি নিয়ে সরকারের কাজকর্মে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। হয়তো সে জন্যই কোথাও কোথাও জমিদাতারা ভরসা হারিয়ে ফেলছেন।”

ঘটনা হল, সরকারি শিল্পতালুকের জন্য জমি দেওয়া হলেও সেখানে শিল্প কেন আসছে না, তা নিয়ে হতাশা রাজ্যের অন্যত্রও রয়েছে। বীরভূমের বোলপুর লাগোয়া শিবপুর মৌজায় অধিগ্রহণের প্রায় ১৪ বছর পরেও পড়ে আছে ১,১৮৭ জন চাষির প্রায় ৩০০ একর জমি। মুখ্যমন্ত্রী চলতি বছরের জুলাই মাসে বোলপুরে বলে এসেছেন, শিল্পের জন্য নেওয়া কৃষিজমির প্রায় অর্ধেকটাতেই হবে টাউনশিপ। এই সিদ্ধান্তকে তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা বলেই মনে করেন জমিদাতাদের একাংশ।

ওই এলাকায় শিল্পের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া ‘শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি’ বর্তমানে শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে। প্রকাশ্যে মুখে কুলুপ আঁটলেও সংগঠনের অনেক সদস্যই ঘনিষ্ঠমহলে বলতে শুরু করেছেন, “শিল্প চাই। চাকরি চাই। এ কথা রাজ্য সরকার না বুঝলে আন্দোলনের পথ খোলাই রয়েছে।” এই মুহূর্তে আন্দোলনে না-গেলেও পশ্চিমবঙ্গ শিল্প ও পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগমের হাতে থাকা ওই জমির প্রায় ২০০ একরে ধানচাষ করে রেখেছেন কমিটির সদস্য-সমর্থকেরা। প্রশ্ন করলে বলছেন, “যত দ্রুত সরকারের টনক নড়ে, তত ভাল। চাষ কী আর এমনি করেছি?” উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুরে সরকারি শিল্পতালুকের জমিদাতাদের আবার অন্য ক্ষোভ। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে গত সাড়ে তিন বছরে সেখানে বন্ধ হয়েছে অন্তত সাতটি কারখানা। আগামী ৫ জানুয়ারি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা দেনার দায়ে নিলাম হওয়ার কথা। স্থানীয় জমিদাতাদের বক্তব্য, কারখানা চালু থাকলে খেয়ে-পরে বাঁচার রাস্তা হবে এই আশায় চাষের জমি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখছেন আম ও ছালা, দুই-ই গিয়েছে।

এই সব দৃষ্টান্ত টেনে আক্রমণ শানাচ্ছেন বিরোধীরা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “শিল্প না-থাকলে রাজ্য যে রসাতলে যায়, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে এবং উদ্বিগ্ন হচ্ছে। শুধু সরকার তা বুঝতে পারছে না, এটাই অদ্ভুত!” আর বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, শুধু কথা হচ্ছে। এ রাজ্যে শিল্পে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। মানুষ এখন নিজের অভিজ্ঞতায় সেটা বুঝতে পারছেন।” এর পরেও মুখ্যমন্ত্রী যে ঘটা করে বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন করবেন, সেই প্রসঙ্গও তুলছেন বাম নেতারা।

খড়্গপুর কলেজ মাঠে প্রশাসনিক সভায় তৃণমূল সাংসদ দেব ও পশ্চিম মেদিনীপুর

জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ (সাদা শাড়িতে)। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।

মুখ্যমন্ত্রীর ভাষ্যে যা ‘বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন’, তা আসলে ‘গ্লোবাল বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট সামিট, বেঙ্গল লিডস’-এর আসর। সরকারি উদ্যোগে ৬-৮ জানুয়ারি কলকাতাতেই বসছে। আগে তিন বার নিষ্ফলা চেষ্টার পরে এটি মমতার চতুর্থ শিল্প সম্মেলন। কিন্তু রাজ্যের শিল্পমহলের বড় অংশ এ বারও লগ্নির ব্যাপারে খুব আশাবাদী নন। তাঁদের মতে, এর একটা কারণ যদি রাজ্য সরকারের শিল্প-বিরূপ নীতি এবং তাদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি হয়, তা হলে অন্য কারণ অবশ্যই শাসক দলের সদিচ্ছার অভাব।

‘শিল্প শিল্পের জায়গায় থাক। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়’ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে বৈঠক সেরে এমনই বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যে সেটা হয় না, তা বলছেন বণিকসভার অনেক কর্তাই। তাঁদেরই এক জনের কথায়, “ভাইব্রান্ট গুজরাতে এ রাজ্যের কেউ থাকছেন না। যেখানে এত বিনিয়োগকারীর সমাবেশ হবে, সেই মঞ্চে উপস্থিত না থাকার পিছনে কারণটা যে রাজনীতি, সেটা আমজনতাও বুঝতে পারবেন। কিন্তু আখেরে এতে রাজ্যই বঞ্চিত হবে।”

শিল্পোদ্যোগীদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, তৃণমূল জমানায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, সিন্ডিকেট-রাজ আর তোলাবাজির দৌলতে সম্ভাব্য লগ্নির গন্তব্য থেকে এ রাজ্যের নাম মুছে ফেলেছে বহু সংস্থা। শিল্পের জন্য বড় জমি দেওয়ার বিরোধিতা, বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের ছাড়পত্র না-দেওয়ার গোঁড়ামিও তাদের বিমুখ করেছে। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র যদিও দাবি করেছেন যে, তৃণমূলের আমলে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা লগ্নি হতেও শুরু করেছে। কিন্তু এমন দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না শিল্পমহলই।

এক শিল্প-কর্তা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বরাবর বলেছেন, জমির মালিকদের স্বার্থের কথা ভেবেই তাঁর দল জমি-নীতি তৈরি করেছে। কিন্তু যাঁদের কথা ভেবে তাঁর নীতি, তাঁদের কর্মসংস্থানের উপায় তিনি ভাবছেন না। কৃষকের ছেলে কৃষক না-ও হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে শিল্প তৈরি না-হলে তাঁর কর্মসংস্থানের উপায় কী, সেটা মুখ্যমন্ত্রী ভাবেননি। আজ তারই ফল ফলছে।

medinipur visit subhendu adhikary mamata bandyopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy